মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
.. জিয়া   থেকে   খালেদা   অতঃপর
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
.. New Book
..ইংরেজী ভার্সন    
 
বদি তুমি অমর
 
   

আগষ্ট মাসের শেষের দিকে দুপুর ১২টায় তেজকুনিপাড়া ছাড়িয়ে তৎকালিন সংসদ ভবনের কাছে আর্মি ইন্টিলিজেন্সের একটি সেফ হাউজের কাছে একটি থ্রি টন লরি এসে থামল। সঙ্গে রয়েছে আর্মি স্কট। গাড়ি থেকে নামানো হল বিভিন্ন বয়সের ৬০/৭০জনকে। সবার অবস্থাই মুমুর্ষ। ঠিকমত হাটতে পারছে না কেউই। রুটিনমাফিক সকালের ইন্টারোগেশন শেষে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদের। রোজ দু’বেলা চালানো হয় ইন্টারোগেশন এর নামে পাশবিক অত্যাচার। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধ ও গেরিলাদের তৎপরতা সম্পর্কে খবর বের করা।

আব্বা ও রয়েছেন এদের সাথে। বেচারা বয়স্ক মানুষ অত্যাচারের মাত্রা সইতে না পেরে বেহুশ হয়ে পড়েছেন প্রায়। বদি অতিকষ্টে নিজের দুর্বল ও বেদনায় জর্জরিত শরীর নিয়েও আব্বাকে প্রায় কাঁধে বয়ে নিয়ে সেলে এল। সেলের একপ্রান্তে ছোট্ট একটা পানির নালকা। বাকি সবাই সেলে ঢুকেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে যন্ত্রনায় কাতঁরাতে লাগল। কেউ কেঁদে উঠল ভেউ ভেউ করে। কেউ অসহ্য পিটুনিতে কুঁকড়ে পড়ে গোঙ্গাতে থাকল নিতান্ত অসহায়ভাবে। বদি তার সব যন্ত্রনা সহ্য করে টেপ থেকে পানি এনে আব্বার শুশ্রষা করতে লাগল অতি যত্ন সহকারে। অল্পক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি দেখলেন বদি তার মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে বসে আছে। বেদম মারের চোটে বদির চোখের নিচে কালশিট পড়েছে। ঠোট ফেটে ফুলে উঠেছে। হাত-পায়ের বিভিন্ন জায়গায় জমাটবাধাঁ রক্তের দাগ। ওর উপরই সবচেয়ে বেশি অত্যাচার চালাচ্ছে পাকিস্তান আর্মির গোয়েন্দা বিভাগ। কারণ বন্দিদের মাঝে একমাত্র বদিই মুখ খুলছে না। সব অত্যাচার মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছে নিশ্চুপ থেকে। অত্যাচারী খানসেনারাও তার সহ্যশক্তি দেখে হতবাক হয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই বদি ওদের কাছে পরিণত হয়েছে কিংবদন্তীর এক নায়কে। ঢাকার বাইরে থেকে পদস্থ অফিসাররা যারাই আসছেন তারাই এই অসীম সাহসী বদিকে একনজর দেখে যাচ্ছেন। তাদের সবার একই প্রশ্ন - কি ধাতুতে তৈরি এই মুক্তিযোদ্ধা?

অত্যাচারের সব তরিকা অবলম্বন করেও তার কাছ থেকে একটি কথাও বের করা সম্ভব হয়নি। আশ্চর্য্য মনোবল ও অবিশ্বাস্য সহ্য শক্তির অধিকারী এই ছেলেটির ভবিষ্যত সম্পর্কে ভেবে আতংকিত হয়ে পড়ছিলেন আব্বা। তার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল।

উচ্চমধ্যবিত্ত ঘরের ঢাকা ভার্সিটির ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র বদি। আব্বা এবং বদির বাবা একসাথে লেখাপড়া করেছেন। বরাবর ষ্ট্যান্ড করা ছেলে। উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে তুচ্ছ করে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের আহুতি দিতে চলেছে। এতটুকু ক্ষেদ নেই। নেই কোন অনুশোচনা। ইষ্পাতকঠিন চারিত্রিক দৃঢ়তায় আব্বা এবং বন্দিদের সবাই হতবাক হয়ে তার জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে দোয়া করছে তার সার্বিক মঙ্গলের জন্য। আব্বা চোখ মেলে তাকালেন। আব্বাকে চোখ মেলতে দেখে বদি মৃদু হেসে বলল,
-চাচা, কেমন বোধ করছেন? ওরা আমাদের অত্যাচার করে সেটা সহ্য হয় কিন্তু আপনার উপর অযথা অত্যাচার সেটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। এটা শুধু অযৌক্তিকই নয়; এটা ঘোরতর অন্যায়। আমিও আর সহ্য করতে পারছি না। কিছু একটা করতে হবে এ অমানুষিক যন্ত্রনার হাত থেকে মুক্তি পেতে। অনেকটা স্বগোক্তিই যেন করল বদি।

পরদিনই ঘটল ঘটনা। সেন্ট্রিরা এসেছে বন্দিদের ইন্টেরোগেশনের জন্য নিয়ে যেতে। সবাই গিয়ে উঠে পড়েছে ট্রাকে। হঠাৎ বদি একজন প্রহরীর হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে অপারগ হয়ে দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করল। কড়া পাহারার নিয়ন্ত্রনে এ বন্দিশালা থেকে পালাবার কোন পথই নেই। ধরা পড়ল বদি। আব্বা কিছুতেই বুঝতে পারলেন না বদির মত তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী ছেলে কেন সব জেনেশুনে এ ধরণের আত্মঘাতী পদক্ষেপ নিল। তাকে গাড়িতে ওঠাবার পর আস্তে আস্তে নিচু গলায় আব্বা ওকে জিজ্ঞেস করলেন,
-বাবা তুমি এটা কি করলে? এর পরিণাম যে হবে ভয়ংকর! স্বভাবসুলভ মৃদু হেসে বদি জবাব দিল,
-চাচা, আমি ভালোভাবেই জানতাম এই দুর্গ থেকে পালানো কিছুতেই সম্ভব নয়। তবুও এই নাটক কেন করেছিলাম জানেন? ভেবেছিলাম এ ধরণের আচরণ করলে ওরা নিশ্চই গুলি করে আমাকে মেরে ফেলবে। ফলে পাশবিক অকথ্য নির্যাতনের হাত থেকে চির নিস্তার পাব।

কী আশ্চর্য্য চরিত্র! মুক্তিযুদ্ধ কিংবা গেরিলাদের কোন খবরই সে দেবে না। তার সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য সে মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নিতে চেয়েছিল! শ্রদ্ধায় আব্বার মাথা সেদিন বদির দেশপ্রেমের গভীরতা দেখে নিচু হয়ে এসেছিল। মনে মনে ভেবেছিলেন যে দেশমাতৃকা বদির মত মুক্তিপাগল সন্তানের জন্ম দিয়েছে; সে দেশের আজাদী বিজাতীয় কোন শক্তির পক্ষেই কুক্ষিগত করে রাখা সম্ভব হবে না।  বদির মত দামাল ছেলেদের আত্মাহুতি কিছুতেই ব্যর্থ হতে পারে না। সেদিন আব্বাদের সাথে বদি ফিরে আসেনি ইন্টেরোগেশনের পর সেফ হাউজে। ফেরেনি বদি স্বাধীনতার পরেও। এ ধরণের হাজারো বদির রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কতটুকু সার্থক হয়েছে? স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে কতজন? এর যথার্থ হিসাব-নিকাশের মাধ্যমেই তাদের আত্মত্যাগের মর্যাদা দিতে হবে বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে।