মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 
বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সামাজিক-রাজনৈতিক সম্পর্কঃ সম্ভাবনা ও সমস্যা
 
   

দু’জন মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে বলা হয় যে, পানির চেয়ে রক্ত বেশী ঘন। বিশ্বাস এবং জীবনের ধরন যদি একই হয় তাহলে এই সম্পর্ক আরও বেশী ঘন হয়। বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান পাকিস্তান একই মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া দু’টি সন্তান বটে। দূর্ভাগ্যবশতঃ এই দুটি দেশ বিভক্ত কিংবা আলাদা হলেও একতা এবং অনেক বিষয়েই সাদৃশ্য রয়েছে। দুবাইতে যখন ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট খেলা হয় তখন বাঙ্গালীরা পাকিস্তানকে সমর্থন করে, তেমনি পাকিস্তানে ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশের মানুষ দুঃখ পায়, অন্যদিকে বাংলাদেশে অতি বন্যা হলে পাকিস্তানীরা ভাবাবেগে অস্থির হয়। ধর্ম (ইসলাম) উভয় দেশকে শক্তভাবে বেঁধে রেখেছে। ইসলাম এমন একটি ধর্ম যে, এই ধর্ম কেউ গ্রহণ করলে এমন সবাই একই উম্মাহর সদস্য হয়। ভৌগলিক এবং রাজনৈতিক সীমানা রেখা উম্মাহর কাছে অতি তুচ্ছ ব্যাপার মনে হয়। এই দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একটি শত্রু দেশ দ্বারা বিভক্ত হলেও একই উম্মাহর দুটি অংশ মাত্র।

উভয়ের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাও এদের একই ভিত্তি দিয়েছে। পাকিস্তানী এবং বাংলাদেশী উভয়েই বৃটিশ ও হিন্দু এই দুটি দৈত্যের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত লড়াই করেছে। বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতা যেমন মাওলানা ভাসানী, শের-ই-বাংলা ফজলুল হক, নবাব সলিমুল্লাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ নেতারা শক্তিশালী বৃটিশদের বিরুদ্ধে কঠিন সংগ্রাম করেছে যাতে ওদের হাড় কাঁপুনি হয়েছিল।

২। অর্থনৈতিক সম্ভাবনা - ১৯৭১ সালের আগে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের একটিমাত্র পারস্পরিক সম্পূরক অর্থনীতি ছিল। বেশীর ভাগ শিল্প কারখানা বর্তমান কালের পাকিস্তানে স্থাপিত হয়েছিল, আর কাঁচামাল উৎপন্ন হত বাংলাদেশে। ১৯৪৭ এর বিভক্তির আগে যতসব শিল্প কারখানা স্থাপিত হয়েছিল তা ছিল পশ্চিম বাংলায়, কাঁচামাল হত পূর্ব বাংলায়, আবার উৎপাদিত মাল বিক্রির বাজার ছিল পূর্ব বাংলা, পূর্ব বাংলা যখন পাকিস্তানের অংশ বা একটি প্রদেশ হয় (‘৪৭ এর পর) এবং পশ্চিম বাংলা ভারতের অংশ হয় তখন পশ্চিম বাংলার অনেক কল-কারখানা বন্ধ হয় কাঁচামাল এবং বাজারের অভাবে।

এই নতুন ব্যবস্থা ভারতীয়দের অপছন্দ হয়, তাই তারা পূর্ব বাংলা পুনঃ ভারতে অঙ্গীভুত করতে সচেষ্ট হয়। এমনকি এখনও দুটি দেশের অর্থনীতিতে গরমিল আছে। এ কারণে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সর্বমোট বাণিজ্য এখন ১৩০ কোটি ডলার যার মধ্যে ওদের পারস্পরিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১২-১৫ কোটি ডলার। বাংলাদেশ তার শতকরা ১২ ভাগ আমদানী পণ্যদ্রব্য আনে ভারত থেকে (কালোবাজারী হিসাব ছাড়াই), কিন্তু ভারতের কঠোর ট্যারিফ আইনের জন্য এবং এন্টি ডাম্পিং আইনের কড়াকড়ির জন্য বাংলাদেশের এই রপ্তানী যথসামান্য মাত্র। অথচ পাকিস্তান এমন কোন নেতিবাচক কড়াকড়ি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আরোপ করেনি। পাকিস্তানের দরকার বাংলাদেশের চা, তন্তু, পাট ইত্যাদি। অন্যদিকে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আমদানী করতে পারে হাল্কা ও মাঝারী প্রকৌশল যন্ত্রপাতি, তুলা, শুকনা ও তাজা ফল ইত্যাদি, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি (ফ্যান, ওয়াশিং মেশিন, এয়ার কন্ডিশনার যন্ত্রাদি)। অন্য জরুরী কথাটি হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূরক, অথচ বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতি প্রতিযোগিতামূলক।

৩। সামাজিক-অর্থনৈতিক বিষয়ে বাধাসমূহ - পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধান বাধা ভারত। বস্তুতঃ ৬০ বছর আগে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু করা হয়েছিল তা এখনও একইভাবে কার্যকর আছে। সেই সময় থেকেই মাঝে মধ্যে কিছু বিরতি দিয়ে সেই ষড়যন্ত্রই চলছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের যে কোন কিছু লাভ ভারতের ক্ষতিই বটে। উভয় দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সরাসরি হলে তা ভারতের ক্ষতির কারণ হয়। তাই ভারত এই যুদ্ধ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কৌশলগত এবং কুটনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর ২৬শে মার্চ উপলক্ষ্যে ভারত তাই বাংলাদেশে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে সেই ১৯৭১ এর নাটকটি বারবার মঞ্চায়নের লক্ষ্যে। এভাবেই তারা বাঙ্গালীদের উঠতি প্রজন্মের মনে ঘৃণা-বিদ্বেষ জিইয়ে রাখতে চায়, যারা কিনা পাকিস্তানীদের বিশ্বাস ও সংগ্রামের ভাই জ্ঞান করে। কেননা, যেদিন বাঙ্গালীরা ওদের আসল নোংরা চেহারা চিনতে পারবে, তখন ওদের পাততাড়ি না গুটিয়ে উপায় থাকবে না। পাকিস্তানীরা সবসময় তাদের হাত বাড়িয়ে রেখেছে আগের মতই ‘বড় ভাই’ দের বিরুদ্ধে, কেননা এ পথেই পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে কোনই সন্দেহ থাকা সমীচিন নয় যে এই দুই ভাইয়ের বাঁচামরা পারস্পরিক ভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ইস্পাত কঠিন সম্পর্ক উভয়ের অস্তিত্বের চাবিকাঠি-যা কোনভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না।

 

সময়কাল -২০০৫