মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার সাড়া জাগানো নিবন্ধ সাপ্তাহিক হলিডেতে ছাপিয়ে পদত্যাগ করেন। কর্নেল তাহেরকেও পদত্যাগে বাধ্য করা হয়।

 
   
 

 

‘এ্যান্টি স্মাগলিং’ এবং ‘অপারেশন ফুড’ থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় সেনা সদস্যদের মাঝে। সবাই এই সিদ্ধান্তে হতাশ এবং ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন।

এই পরিস্থিতিতে কর্নেল জিয়াউদ্দিন (ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার) অভিমত প্রকাশ করেন, “বর্তমান সরকারের অধিনে সামরিক বাহিনীতে থেকে জনগণের স্বার্থে কাজ করা সম্ভব নয়। সরাসরিভাবে সরকারের বিরোধিতা করাও সম্ভব নয়। তাই সরকারি অপশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের মাঝ থেকেই গড়ে তুলতে হবে দুর্বার প্রতিরোধ সংগ্রাম।” তার অভিব্যক্তিতে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেলাম। তিনি সক্রিয় রাজনীতির কথা ভাবছেন। তার অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে সেনা পরিষদের মনোভাব ছিল তার বক্তব্য অবশ্যই যুক্তিসম্পন্ন। সরকার বিরোধী আন্দোলনকে বিজয়ের চুড়ান্ত পর্যায়ে এগিয়ে নেয়া সম্ভব জনগণের রাজনৈতিক আন্দোলনে গতিশীলতা সৃষ্টি করেই। মূলতঃ এ দায়িত্ব পালনের ভার দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী দল ও নেতৃত্বের উপর। তবে আমরাও সেনাবাহিনীর ভেতরে অবস্থান করেও জনগণের আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারব যদি নিজেদের সংগঠিত করতে পারি।

১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকালে সাপ্তাহিক হলিডে-তে কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার সাড়া জাগানো নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এ নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি সরাসরি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। তিনি তার নিবন্ধে লেখেন, “Independence has become an agony for the people of this country. Stand on the street and you see purposeless, spiritless, lifeless faces going through the mechanics of life. Generally, after a liberation war, the new spirit carries through and the country builds itself out of nothing. In Bangladesh, the story is simply other way round. The whole of Bangladesh is either begging or singing sad songs or shouting without awareness. The hungry and poor are totally lost. The country is on the verge of falling into the abyss.”

নির্ভিক এই মুক্তিযোদ্ধা এই নিবন্ধে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পচিঁশ বছরের গোপন চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি সর্বপ্রথম তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, “We fought without him and won. If need be we will fight again without him.”

শেখ মুজিবর রহমান সে সময় লন্ডনে গলব্লাডার অপারেশনের পর সুইজ্যারল্যান্ডের এক স্বাস্থ্যনিবাসে অবস্থান করছিলেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিনের লেখা দেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে জানতে পেরে তড়িঘড়ি করে তিনি দেশে ফিরে এলেন। কর্নেল জিয়াউদ্দিনের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক কষ্টের এবং ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা নিয়ে যে কোন ষড়যন্ত্রের বিরোধিতা করতে আবার প্রয়োজনে অস্ত্র হাতে তুলে নিতে দ্বিধাবোধ করবেন না তারা। তার এই লেখা থেকে দেশবাসী প্রথম পরিষ্কারভাবে জানতে পারেন, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। প্রমাদ গুনলেন আর্মি চীফ শফিউল্লাহ। তিনি জিয়াউদ্দিনকে হাতেপায়ে ধরে অনেক মিনতি করেছিলেন যেন শেখ সাহেব ফিরে এলে ছাপানো নিবন্ধের জন্য তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। কারণ শফিউল্লাহ বুঝতে পেরেছিলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিনের লেখা রাজনৈতিক মহলে বিশেষ করে তরুণ ও ছাত্রসমাজ এবং সেনাবাহিনীতে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সেনাবাহিনীতে কোন প্রকার বিষ্ফোরন যাতে না ঘটে তার জন্যই মিনতি জানিয়েছিলেন তিনি। শেখ মুজিব দেশে ফিরে বিষ্ফোরম্মুখ অবস্থার গুরুত্ব উপলব্দি করতে পেরে জেনারেল শফিউল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন কি করে অবস্থার সামাল দেয়া যায়? শফিউল্লাহ শেখ সাহেবকে জানালেন, নিবন্ধ ছাপানোর পর কর্নেল জিয়াউদ্দিনের ভাবমুর্তি তরুণ অফিসার এবং জোয়ানদের মধ্যে আরো বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় কর্নেল জিয়াউদ্দিনের প্রতি কোন কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হলে আর্মির মধ্যে আকষ্মিক বিষ্ফোরন ঘটে যেতে পারে। শেখ মুজিব তার মোড়লী বুদ্ধি দিয়ে ঠিক করলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে ডেকে কিছু বকাবকি করে তাকে দিয়ে কৌশলে মাফ চাইয়ে নেবেন। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে বলা হল জেনারেল সফিউল্লাহকে। গণভবনে জিয়াউদ্দিনকে নিয়ে এলেন শফিউল্লাহ। প্রধানমন্ত্রীর ঘরে ঢুকে স্যালুট করে দাড়াতেই গর্জে উঠলেন শেখ মুজিব, “তুমি কোন সাহসে এ ধরণের নিবন্ধ ছাপালে? জানো, তোমার অপরাধ রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান? সামরিক বাহিনীতে চাকুরীরত অবস্থায় এ ধরণের লেখা ছাপানো বেআইনী। আমি তোমাকে এ ধরণের  গুরুতর অপরাধের জন্য কঠিন শাস্তি দিতে পারি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তোমার বিশেষ অবদানের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের মত তোমাকে আমি মাফ করব যদি তুমি শফিউল্লাহকে লিখিতভাবে দাও যে, তুমি অন্যায় করেছ।” একনাগাড়ে বলে গেলেন শেখ মুজিব। সবকিছুই চুপ করে শুনলেন কর্নেল জিয়াউদ্দিন।

তিনি জবাব দিলেন, “শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী। আপনার দয়া-দাক্ষিণ্য আমার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। কারণ আমি কোন অন্যায় করিনি। আমি যা লিখেছি সেটা আমার বিশ্বাস। অতএব, ক্ষমা চাওয়ার কিংবা ক্ষমা পাওয়ার কোন অবকাশ নেই এখানে। আপনি ঠিকই বলেছেন যে, চাকুরীতে থাকাকালীন অবস্থায় এ ধরণের লেখা ছাপানো অন্যায়। তাই আমি আমার কমিশনে ইস্তফা দিয়েই আমার নিবন্ধ ছেপেছি।” এভাবেই সেদিন শার্দুল সন্তান কর্নেল জিয়াউদ্দিন শেখ মুজিবকে স্তম্ভিত করে দিয়ে গণভবন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। তার বেরিয়ে আসার পর শফিউল্লাহকে শেখ মুজিব অনুরোধ করেছিলেন জিয়াউদ্দিনকে বোঝাবার জন্য। হেডকোয়াটার্সে ফিরে এসে জেনারেল শফিউল্লাহ, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ প্রমুখ অনেকেই কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। জিয়াউদ্দিন তাদের চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন তার শাণিত জবাব দিয়ে। তিনি বলেছিলেন, নিজের আত্মার সাথে বেঈমানী করতে পারবেন না সামান্য চাকুরীর লোভে। তাছাড়া তাদের মত মেরুদন্ডহীন কমান্ডারদের অধিনে একই সংগঠনে তাদের অধিনস্ত হয়ে চাকুরী করে তিনি তার আত্মসম্মান খোয়াতে রাজি নন। এভাবেই সেনাবাহিনীতে ইস্তফা দিয়ে তিনি পরে সর্বহারা পার্টিতে যোগদান করেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর অন্যায়ভাবে কর্নেল তাহেরকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে ড্রেজার অর্গানাইজেশনের পরিচালক পদে নিয়োগ করা হয়। এই নতুন পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর কর্নেল তাহের জাসদের সশন্ত্র গোপন সংগঠন ‘গণবাহিনী’ গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনী থেকে তাকে বের করে দেবার পরও আমাদের যোগসূত্র ছিন্ন হয়নি কখনো। আমরা আমাদের স্ব স্ব অবস্থানে থেকে একই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে থাকি। লক্ষ্য একটাই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন। গণতান্ত্রিক সুষম সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধশালী এবং মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে সাহায্য করা। আমাদের মাঝে আদর্শগত বন্ধন এত সুদৃঢ় ছিল যে, আমরা বিশ্বাস করতাম জাতীয় মুক্তির বৃহৎ স্বার্থে যেকোন ক্রান্তিলগ্নে আমরা সবাই এক হয়ে লড়তে পারব নির্দ্ধিধায়।