মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

সেনা পরিষদ

 
   
 

 

সেনা বাহিনীর কিছু সমমনা সদস্য সেনা পরিষদ গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত সব অফিসারদের ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীতে পুনর্বাসন করা হয়। শেখ মুজিবর রহমানের বিশেষ আস্থাভাজন এ সমস্ত অফিসারদের একটি অংশ শেখ সাহেবের চোখ ও কান হিসাবে সেনাবাহিনীর উপর নজর রাখছিল। প্রভাবশালী এই মহলটির করুণা পেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ এগিয়ে নেবার জন্য তাদের দালালি করতে তখন অনেকেই নীতি বিসর্জন দিয়ে তাদের এজেন্ট হয়ে যান। এদের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর সব খবরা-খবর শেখ মুজিবের কান অব্দি পৌঁছে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হল।

সেই সময় এদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা কিছু তরুণ অফিসার উদ্যোগ নেই ব্যক্তিগত যোগাযোগ এবং মত বিনিময়ের মাধ্যমে সচেতন দেশপ্রেমিক ও সমমনা ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি অঘোষিত সংগঠন গড়ে তোলার। প্রতিষ্ঠিত হয় সেনা পরিষদ। সেনা পরিষদ সরকারের প্রতিটি নীতিও পদক্ষেপ সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ থাকত। প্রতিটি পদক্ষেপ এবং ইস্যুর চুলচেরা বিশ্লেষন করে জাতীয় পরিসরে এবং সামরিক বাহিনীর উপর এসমস্ত নীতি পদক্ষেপের প্রভাব এবং প্রতিক্রিয়া কি হবে অথবা হতে পারে সে বিষয়ে অধিনস্ত সৈনিকদের বুঝিয়ে বলা হত সেনা পরিষদের তরফ থেকে। সৈনিকদের সচেতনতার মান বাড়িয়ে তোলার জন্যই এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলাম আমরা। সরকারি নীতি ও কার্যক্রম সম্পর্কে দৃষ্টি রাখা ছাড়া দেশ ও জাতির ভবিষ্যত নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করত সেনা পরিষদ। কি হচ্ছে, কি হওয়া উচিত, কি উচিত নয় বিভিন্ন জাতীয় সমস্যা এবং সম্ভাব্য সমাধান প্রভৃতি বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা করা হত সেনা পরিষদের ষ্টাডি সার্কেলগুলোতে। সবকিছুই করা হত অতি সর্তকতার সাথে, গোপনে। বেসামরিক আমলা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি মহলের দেশপ্রেমিক সচেতন সদস্যদের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন সূত্রে যোগাযোগ রক্ষা করে মত বিনিময় করতেন সেনা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সদস্যরা। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের বিভিন্ন স্তরের অনেকের সাথেও যোগাযোগ ছিল সেনা পরিষদের। আন্তরিকভাবে নিয়মিতভাবে খবরা-খবর আদান-প্রদান এবং খোলামেলা মত বিনিময়ের ফলে ক্ষেত্র বিশেষে অনেকের সাথে সেনা পরিষদের সদস্যদের সম্পর্ক নিবিড় হয়ে উঠে। সেনাবাহিনীর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও সেনা পরিষদের সদস্যরা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হন। অনেকের সাথে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বও গড়ে উঠে। আলোচনাকালে অনেকেই মত পোষণ করেন- জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে জনগণকে শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে বাচাঁবার সংগ্রামে সেনা বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশকে অগ্রণী হয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার দায়িত্ব নিতে হবে, এর কোন বিকল্প নেই।

তাদের এ ধরণের বক্তব্যের জবাবে সেনা পরিষদের তরফ থেকে বলা হত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জনগণের মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার জন্য কিছু করণীয় থাকলে সে দায়িত্ব যেকোন ত্যাগের বিনিময়ে পালন করতে প্রস্তুত রয়েছে সেনা পরিষদ তবে সেনা পরিষদের যে কোন ভূমিকাই হবে সহায়ক শক্তি হিসেবে সংগ্রামকে এগিয়ে নেবার লক্ষ্যে; নিজেদের ক্ষমতা দখলের জন্য নয়। তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা কিংবা সামাজিক অস্থিরতার সুযোগে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখল এবং রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ার ফলে কোন দেশেই গণতান্ত্রিক সুষম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি; প্রতিষ্ঠিত হয়নি মানবিক অধিকার। একমাত্র সুষ্ঠ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সম্ভব সার্বিক আর্থ-সামাজিক মুক্তি অর্জন আর এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বের দায়িত্ব অবশ্যই নিতে হবে পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল রাজনীতিবিদদের। এটাই ছিল সেনা পরিষদের দৃঢ় বিশ্বাস।

এ সম্পর্কে মেজর রফিক পিএসসি তার বই ‘বাংলাদেশ সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট’ এ লিখেছেন, “সমসাময়িক ইতিহাসে কম্বোডিয়া, গণচীন, কিউবা, ভিয়েতনাম তথা সর্বত্রই মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন হবার পর ক্ষমতা দখল করেছে। শুধু বাংলাদেশেই ঘটেছে এর ব্যতিক্রম। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ মুক্ত হওয়ার পর অস্ত্র সমর্পন করেছে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে; দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন বাধার সৃষ্টি করেনি। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণকারী অফিসার-সৈনিকেরা স্বাভাবিকভাবেই দেশের দারিদ্রতা, অর্থনৈতিক অবক্ষয় ও দুর্নীতি দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সৈনিকরা সরকার পরিচালনার মত একটি দূরহ রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে থাকে। মেজর ডালিম, মেজর পাশা, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার তখন কুমিল্লা সেনানিবাসে চাকুরিরত ছিলেন। এরা প্রায়ই অবসর সময়ে মিলিত হতেন এবং দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ লোকদের নিয়ে সরকার পরিচালনা এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা সর্ম্পকে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন। এভাবে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। ১৯৭২ সালে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্নেল তাহের ও ঢাকা সেনানিবাসে কর্নেল জিয়াউদ্দিন প্রতি সপ্তাহে ষ্টাডি পিরিয়ডের নামে অফিসারদের সমবেত করে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে তরুণ অফিসারদের সঙ্গে সমালোচনায় লিপ্ত হতেন।”