মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চরিত্র এবং প্রত্যয়

 
   
 

 

স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতি যখন শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লীগের ভারত তোষণ নীতি, ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি, সীমাহীন দুর্নীতি, অবাধ চোরাকারবার, রক্ষীবাহিনী এবং ব্যক্তিগত বাহিনী সমূহের ত্রাস, দমন নীতি, দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান উর্দ্ধগতি, অর্থনৈতিক নৈরাজ্য, সমাজতন্ত্রের নামে জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাহীনতা এবং আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত; তখন সেনা বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তারা শাসকদের হাতে শোষণের হাতিয়ার না হয়ে জনগণের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকবেন।

এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা মহাদেশের প্রায় সব দেশই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো অস্ত্রবলে দখল করে নেয়। দখল করে নেবার পর ঔপনিবেশিক প্রভুরা প্রতিটি দেশে জাতীয় শোষক শ্রেণীর যোগসাজসে গড়ে তোলে দু’টো প্রশাসনিক হাতিয়ার, সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্র। নিজেদেরকে জনগণের প্রত্যক্ষ শোষক হিসেবে প্রতিপন্ন না করার এক অপূর্ব ব্যবস্থা। ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা’ তোলার এ কৌশল গ্রহণ করে জাতীয় শোষক শ্রেণীকে যৎসামান্য সুখ-সুবিধা দিয়ে জাতীয় সম্পদের সিংহভাগ তারা নিয়ে যায় নিজেদের দেশে। জাতীয় শোষক শ্রেণীকে বশীভূত করে তাদের বিদেশী ধ্যান-ধারণা ও সংস্কৃতির প্রতি তাদের আকৃষ্ট করতেও সমর্থ হয় ঔপনিবেশিক প্রভুরা প্রগতি ও মানবতাবাদের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে। বিজাতীয় শোষণের বিরুদ্ধে ক্রমান্বয়ে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে জনগণের মাঝে। তারা মনে করে বিদেশী শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হলেই তাদের দাসত্ব ঘুচেঁ যাবে। দেশের উন্নতি হবে এবং জীবনের মান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে। তারই ফলে শুরু হয় জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম। সংগ্রামের প্রচন্ডতার মুখে এক পর্যায়ে প্রত্যক্ষ শোষণ টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়লে ঔপনিবেশিক শাসকরা পরোক্ষ শোষণের বন্দোবস্ত করে। জাতীয় উচ্চবিত্ত ও তাদের দোসরদের নেতৃত্বে স্বাধীনতা দান করে প্রতিটি দেশের উপর পরোক্ষভাবে তাদের শোষণ কায়েম রাখে। বিদেশী প্রভুদের জায়গায় নতুন দেশী প্রভুরা ক্ষমতায় আসীন হয়ে তাদের প্রভুদের শিক্ষা অনুযায়ী এবং প্রভুদের প্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনী, শাসন ব্যবস্থা ও আমলাতন্ত্রকে অটুট রেখে নিজেদের স্বার্থে জনগণের বিরুদ্ধে তাদের প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে থাকে। জাতীয় শোষক শ্রেণীর এই ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় শুরু হয় জাতীয় শোষণ ও শাসন। ফলে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। দেশগুলো আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে। ঐতিহাসিক সূত্রে অর্থনৈতিকভাবে জরাজীর্ণ এসমস্ত দেশগুলোর শাসনভার যারা গ্রহণ করে তাদের অযোগ্যতা, প্রশাসন চালানোর অনভিজ্ঞতা, লোভ-লালসা, কোন্দল এবং ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়ায় পালাক্রমে ক্ষমতা হাতবদল হতে থাকে সামরিক-বেসামরিক আমলা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের দ্বারা গঠিত দলগুলোর মধ্যে। এই ‘মেরি গো রাউন্ড’ এর গোলক ধাধাঁয় আজও তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ঘুরপাক খাচ্ছে।

সামরিক বাহিনীই ক্ষমতায় থাকুক আর বেসামরিক রাজনৈতিক নেতারাই ক্ষমতায় থাকুক তাদের শিকড় একই শ্রেণীতে। তাই তাদের মধ্যে থাকে এক অটুট বন্ধন। তাদের মধ্যে ক্ষমতার লড়াইকে রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে জাহির করার প্রচেষ্টা একটা প্রহসন মাত্র। জনগণকে বোকা বানানোর আরেকটি কায়দা। তাদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যতই তীব্র হোক না কেন জনগণের বিরুদ্ধে নিজেদের কায়েমী স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা নিজেদের বিবাদ ভুলে সব এক হয়ে যায়। এর ফলেই সম্ভব হয় সমঝোতার মাধ্যমে লোক দেখানো গণতন্ত্রের খেলা, দলবদলের ভেলকিবাজী। এই উদ্দেশ্যেই মুক্তিযুদ্ধের অস্বাভাবিক ইতি টানার সাথে সাথে ঔপনিবেশিক ছাচে গড়া রাষ্ট্রযন্ত্রগুলো পুরোপুরি অক্ষুন্ন রাখার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছিল।

কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সৃষ্টি, ইতিহাস ও চরিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। পাকিস্তান স্বাধীন করার সংগ্রামে পূর্ব বাংলার জনগণ অগ্রণী ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্রিটিশ সৃষ্ট শাসন যন্ত্রকে ব্যবহার করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে ঔপনিবেশিক কায়দায় শাসন-শোষণের যাতাকলে পিষতে থাকে। এরই ফলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। স্বৈরতন্ত্র বিরোধী জাতীয়তাবাদী এ সংগ্রামে গণতান্ত্রিক চেতনাও গড়ে উঠতে থাকে। সংগ্রামের মূল লক্ষ্য ছিল দেশ স্বাধীন করে গণতান্ত্রিক, জনগণের মৌলিক এবং মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করে স্বনির্ভর সুষম সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠিদের নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছিল তৎকালীন সেনাবাহিনী এবং প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বাঙ্গালী সদস্যদেরও। তাদের উপরও করা হয়েছিল  অন্যায়-অবিচার। ফলে গোড়া থেকেই তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছেন জাতীয় সংগ্রামে। জাতীয় মুক্তির রাজনৈতিক সংগ্রামের চরম স্তরই ছিল ’৭১ এর স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম। হানাদার বাহিনীর আচমকা হামলার মুখে যখন রাজনৈতিক নেতারা জাতিকে লক্ষ্যহীন অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে রেখে পালিয়ে যান তখন ঔপনিবেশিক ছাঁচে গড়া সেনাবাহিনীরই এক জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। সেনাবাহিনী, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও পুলিশ বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যরাই প্রথম বিদ্রোহ করেন এবং কৃষক, শ্রমিক, যুবক, ছাত্র, প্রশাসনিক আমলাদের একাংশ এবং জনগণের সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় দেশব্যাপী প্রতিরোধ সংগ্রাম। জনগণের সাথে সৈনিকদের চেতনা, আশা-আকাংখা এক হয়ে মিলে গিয়েছিল বলেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতার সংগ্রাম। পরবর্তিকালে নয় মাস জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন তারা। শ্রেণী বিন্যাসের সব বাধাঁ ভেঙ্গে তারা নিজেদের পরিচয় কায়েম করেন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন জনগণের সাথে এক হয়ে গিয়ে যুদ্ধ সংগঠিত করছিলেন তখন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের বেশিরভাগ সদস্য ভারতে পালিয়ে গিয়ে ভারতীয় সরকারের সহায়তায় তথাকথিত মুজিবনগর প্রবাসী সরকার গঠন করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের একক নেতৃত্বের দাবিদার হয়ে বসেন। যুদ্ধক্ষেত্রে না যেয়ে অবস্থান নেন কোলকাতার ৫৮নং বালিগঞ্জ, ৮নং থিয়েটার রোড এবং ১৯নং সার্কাস এ্যাভেনিউতে। এভাবেই তারা নিজেদের ভারতীয় চক্রান্তের ক্রীড়ানকে পরিণত করেন। মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিলেন তাদের আত্মত্যাগ, তিতিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাবেন তাদের সংগ্রাম আর তারই ফলে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে পরীক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব; যারা পরিচালিত করবে মুক্তি সংগ্রাম। স্বাধীনতার পর তারা গড়ে তুলবেন জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। কিন্তু ভারতীয় সেনা বাহিনীর হস্তক্ষেপের ফলে মুক্তিযুদ্ধ সেই স্বাভাবিক পরিণতি লাভ করতে পারেনি। ফলে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেন তাদের বদলে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা চলে গেল আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে।

যেসব বাঙ্গালী সৈনিকরা ঔপনিবেশিক ধাচেঁ গড়া সেনা বাহিনীর কাঠামো ভেঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাদের আবার জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া হল। গড়ে তোলা হল পুরনো ধাচেঁর সশস্ত্র বাহিনী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের বেশিরভাগই তখন হয়ে উঠেছিলেন রাজনৈতিকভাবে সচেতন। এই সচেনতার বিকাশ ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাই বিশ্বের অন্যান্য গতানুগতিকভাবে সৃষ্ট সেনা বাহিনীগুলোর ধাঁচে তাদের আবার সংগঠিত করলেও চারিত্রিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। মুক্তিযোদ্ধাদের বৃহৎ অংশই ছিলেন নিঃস্বার্থ অকুতোভয়, দেশপ্রেমিক। কর্তব্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ, স্পষ্ট বক্তা মুক্তিযোদ্ধারা কোন অন্যায়কে মেনে নেননি যুদ্ধের সময় থেকেই। সীমিত গন্ডির ভেতরে থেকেও তারা সব অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন; সুযোগ মত অন্যায়কে প্রতিহত করার চেষ্টাও করেছেন সাধ্যমত। তাই ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণায় এ ধরণের চরিত্রের সেনাবাহিনীকে জাতির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ব্যারাকে আবদ্ধ রাখার চিন্তা-ভাবনা ছিল নেহায়েতই অবাস্তব। সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা সমাজ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের প্রতি জনগণের মত তারাও স্বাভাবিকভাবে ছিলেন সদা সচেতন। সেই কারণেই ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণায় সেনা সদস্যদের জাতির কাছ থেকে দূরে সরিয়ে ব্যারাকে আবদ্ধ করে রাখার সরকারি প্রচেষ্টা ফলদায়ক হয়নি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে। জনগণ ও সেনা সদস্যদের মাঝে গড়ে উঠা দেশপ্রেমের অটুট বন্ধনের গভীরতা অনুধাবন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন আওয়ামী-বাকশালী শাসকগোষ্ঠি। সৈনিকদের ব্যারাকে আবদ্ধ করে রাখলেও তাদের সিংহভাগই দেশের রাজনৈতিক গতিধারার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখে চলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কারণেই। শুধু বাইরেই তার প্রকাশ ছিল না। এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করে পুরনো ধাঁচের রাষ্ট্রযন্ত্র দিয়ে পশ্চিমা শাসকদের স্থলাভিষিক্ত আওয়ামী লীগ সরকার দেশ শাসন করতে গিয়েও চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সেনা বাহিনীর মধ্যেও বিক্ষোভ ধুঁমায়িত হয়ে উঠতে থাকে।