মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ সালের বৈপ্লবিক সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান

 
   
 

 

ব্যাংককের উদ্দেশ্যে আমাদের দেশ ত্যাগের পর মাত্র ৩ দিনের মধ্যেই সেনা পরিষদ এবং গণবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে ব্রিগেডিয়ার খালেদ চক্রের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। অন্যান্য দেশপ্রেমিক এবং প্রগতিশীল শক্তিসমূহও ঐ অভ্যুত্থানে যোগ দেয়। দেশপ্রেমিক বীর সেনানীদের সাথে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যোগ দেয় জাগ্রত জনতা।

আমাদের দেশ ত্যাগের মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে মূলতঃ সেনা পরিষদ এবং কর্নেল তাহেরের অধিনস্থ গণবাহিনীর যৌথ নেতৃত্বে সংঘটিত হয় ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লব। ক্ষমতাচ্যুত হয় খালেদ চক্র। জাতীয় বেঈমান ও তাদের বিদেশী প্রভুদের সব চক্রান্তের জাল ছিন্নভিন্ন করে দেয় অকুতোভয় দেশপ্রেমিক সৈনিকেরা। দেশের আপামর জনসাধারণ ৭ই নভেম্বরের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন জানিয়ে সেনাবাহিনীর বীর জোয়ানদের সাথে যোগ দেয় ঠিক একইভাবে যেভাবে তারা সমর্থন জানিয়েছিল আগষ্ট বিপ্লবকে। এই দুই ঐতিহাসিক দিনে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র সংগ্রামী জনতার ঢল নেমেছিল পথে-প্রান্তরে, অলিতে-গলিতে, শহরে-গ্রামে। নামাজে শুক্‌রানা আদায় করেছিলেন মুসল্লিরা মসজিদে-মসজিদে। শহর-বন্দরে খুশীতে আত্মহারা জনগণের মাঝে মিষ্টি বিতরণের ধুম পড়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ এবং জনগণের একাত্মতায় সৃষ্টি হয়েছিল এক র্দুভেদ্য জাতীয় ঐক্য। সেই দুই   ক্রান্তিলগ্নে সম্মিলিতভাবে তারা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল এক দুর্জয় ঘাঁটিতে। সমগ্র জাতি প্রস্তুত ছিল জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যেকোন আগ্রাসন কিংবা হুমকির বিরোধিতা করার জন্য। সফল বিপ্লবের পর কুচক্রীদের নেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং তার কয়েকজন ঘনিষ্ট সহযোগী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। কর্নেল শাফায়াত জামিল ও অন্যান্যদের বন্দী করা হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে আবার তাকে আর্মি চীফ অফ স্টাফের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তিনি জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার আবেদন জানান। কিন্তু জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ জেনারেল জিয়াউর রহমানের আবেদনে পুনরায় রাষ্ট্রপতি হতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি ঐদিনই জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দান করে ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে পূর্ণ সমর্থন জানান।

১৫ই আগষ্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনা দুইটি বিচ্ছিন্ন নয়। ঘটনা দুইটি একই সূত্রে বাঁধা। একই চেতনায় উদ্ভুদ্ধ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল এই দুইটি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান। ১৫ই আগষ্ট অগ্রণীর ভূমিকায় ছিল সেনা পরিষদ আর ৭ই নভেম্বর একই দায়িত্ব যৌথভাবে পালন করেছিল সেনা পরিষদ এবং কর্নেল তাহেরের অধিনস্থ গণবাহিনী। এই দুইটি ঐতিহাসিক জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের চেতনা ছিল জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার চেতনা, গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেতনা, ইন্দো-সোভিয়েত বলয়ের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার চেতনা, স্বৈরশাসন ও একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে শ্বাসরূদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার চেতনা- এক কথায় বলতে গেলে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর এই সময়ের আমার এ ঘটনা বিবরণের স্বপক্ষে প্রমাণ হয়ে আছে ৭ই নভেম্বর সফল বিপ্লবের পর সৈনিক-জনতার মুখে ধ্বনিত শ্লোগানগুলি। সেদিন ঢাকার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল গগনবিদারী শ্লোগানে,
- নারায়ে তাক্‌বীর। আল্লাহু আক্‌বর।
- সিপাহী-জনতা ভাই ভাই। খালেদ চক্রের রক্ত চাই।
- খন্দোকার মোশতাক জিন্দাবাদ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
- মেজর ডালিম জিন্দাবাদ। কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ।
- ডালিম তাহের ভাই ভাই। বাকশালীদের রক্ষা নাই।
- রশিদ-ফারুক জিন্দাবাদ। খালেদ মোশাররফ মুর্দাবাদ।
- জেনারেল জিয়া যেখানে, আমরা আছি সেখানে।

১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ এর বৈপ্লবিক সফল অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। অম্লান হয়ে থাকবে নিজ মহিমায়। সেদিন আগষ্ট বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মাটি থেকে স্বৈরশাসনের একনায়কত্ব ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটেছিল এবং উম্মোচিত হয়েছিল বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দ্বার। আগষ্ট বিপ্লব বাকশালী কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে রাজনীতিতে গতিশীলতার সৃষ্টি করে সূচনা করে এক নতুন দিগন্তের। ’৭৫ এর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সময় বাকশালী প্রবীণ নেতা মরহুম আব্দুল মালেক উকিল লন্ডন সফর করছিলেন। মুজিব হত্যার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তখন সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “বাংলাদেশে ফেরাউনের পতন হয়েছে।” আওয়ামী-বাকশালী নেতা জনাব মহিউদ্দিন আহমদ খন্দোকার মোশতাক সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে ছুটে গিয়েছিলেন সোভিয়েত নেতৃবৃন্দকে আগষ্ট বিপ্লবের অপরিহার্যতা বুঝিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করার জন্য। জনাব আবু সাইদ চৌধুরী মুজিব সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতিও স্বেচ্ছায় খন্দোকার মোশতাকের বিশেষ দূত হিসেবে ও পরবর্তিকালে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র সফর করে আগষ্ট বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে সে সমস্ত দেশের নেতৃবৃন্দকে অবহিত করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৫ই আগষ্ট বৈপ্লবিক অভুত্থান ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল জাতীয় জীবনের প্রতিক্ষেত্রে তারই ধারা আজও দুর্বার গতিতে বয়ে চলেছে। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম ও জাতীয় মুক্তির প্রতীক ১৫ই আগষ্টের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ও তার চেতনা সর্বকালে সর্বযুগে এদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক ও সচেতন নাগরিক ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে প্রেরণা যোগাবে নব্য সৃষ্ট মীরজাফর ও জাতীয় বেঈমানদের উৎখাত করতে। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার জ্বলন্ত নিদর্শন ১৫ই আগষ্টের মহান বিপ্লব।

 
 
 
     
     
  Design & Developed By: Hemu
All Rights Reserved 2008 @www.majordalimbangla.net