মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

ফিরে গেলাম ৪র্থ বেঙ্গল হেডকোয়াটার্সে

 
   
 

 

রাষ্ট্রপতির সাথে বৈঠক শেষ করে আমরা ফিরলাম ৪র্থ বেঙ্গল হেডকোয়াটার্সে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ চাইছিলেন আমরাও তার সাথে যোগ দেই।

প্রেসিডেন্টের জবাব শুনার পর কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেকের সঙ্গে ফিরে এলাম ৪র্থ বেঙ্গল হেডকোয়াটার্স এ। ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং অন্যান্য সবাই আমাদের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় উদ্গ্রীব হয়ে ছিলেন।

কর্নেল মান্নাফ সবার উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরলেন। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য শুনে ব্রিগেডিয়ার খালেদ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন, খন্দোকার মোশতাকের কাঁধে বন্দুক রেখে তার অভিসন্ধি হাসিল করা সম্ভব হবে না। ব্রিগেডিয়ার খালেদের চাল যে করেই হোক না কেন তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী জনাব মোশতাক ধরে ফেলেছেন এবং তাই তিনি তার ফাঁদে পা দিতে অস্বীকার করেছেন। মুহুর্তে চাঁপা আক্রোশে ফেটে পড়ল সবাই। কর্নেল শাফায়াত ক্ষোভে বলে উঠলেন,
- How dare he speak like that? তাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ বলে উঠলেন,
- Allright, we shall see. বলেই কর্নেল শাফায়াত, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান, ব্রিগেডিয়ার মঈন, মেজর হাফিজ, ক্যাপ্টেন ইকবাল, স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত, কর্নেল রউফ, মেজর মালেক প্রমুখকে সঙ্গে করে বেরিয়ে গিয়ে পাশের রুমে রুদ্ধদ্বার আলোচনায় বসলেন। খালেদ চক্রের মূল সমস্যা ছিল, সেনা পরিষদের সাংগঠনিক শক্তি, সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে জেনারেল জিয়ার এবং জাতীয় পরিসরে মোশতাক সরকারের জনপ্রিয়তা। আমাদের সমস্যা ছিল খালেদ চক্রের বাকশালপন্থী চেহারা উন্মোচিত না হওয়া পর্যন্ত বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ২৫বছর মেয়াদী চুক্তির আওতায় ভারতীয় প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের সুযোগ না করে দেয়া। মিনিট বিশেক পর তারা ফিরে এলেন নিজেদের মাঝে আলাপ-আলোচনা শেষ করে।
- ডালিম, খন্দোকার মোশতাক যখন আমাদের দাবিগুলো মেনে নিয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করতে রাজি হচ্ছেন না; সেক্ষেত্রে তাকে প্রধান বিচারপতি জাষ্টিস সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। বললেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ।
- জাষ্টিস সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করাটা হবে সংবিধান বিরোধী। তাছাড়া, আইনের মানুষ হয়ে জাষ্টিস সায়েম কি অসাংবিধানিকভাবে এভাবে রাষ্ট্রপ্রতি হতে সম্মত হবেন? জবাবে প্রশ্ন করলাম আমি।
- Well,  যে ভাবেই হোক না কেন; এই হস্তান্তরকে আইনসম্মত করে নিতে হবে। জাষ্টিস সায়েমকে রাজি করাবার দায়িত্ব আমার।

ব্রিগেডিয়ার খালেদের কথা থেকে আঁচ করতে অসুবিধা হল না কোন অদৃশ্য সুতার টানে তিনি এ ধরণের সংবিধান বর্হিভূত একটা সমীকরণের প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন; কোন একটা বিশেষ মহলের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য।
- এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির সাথে আলাপ না করে আমরা কিছুই বলতে পারব না স্যার। আপনি আপনার প্রতিনিধিদের আমাদের সাথে দিয়ে দেন; বঙ্গভবনে ফিরে রাষ্ট্রপতির সাথে আলাপের পর তার জবাব তারা আপনার কাছে নিয়ে আসবেন।
- বেশ তাই হবে। সম্মত হলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ।
- Well Sir, if there is nothing else from your side then I think we should leave now. বলে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। সেই ক্ষণে অপ্রত্যাশিতভাবে খালেদ ভাই বললেন,
- ডালিম, একটা কথা- আমরা জানি তুমি, নূর, পাশা, শাহরিয়ার, হুদা, রাশেদ, মহিউদ্দিন ও অন্যান্যরা সবাই নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। স্বাধীনতা যুদ্ধকাল থেকেই দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ধ্যানধারণাও প্রায় এক। আমাদের তরফ থেকে আমি পরিষ্কারভাবে বলছি, কর্নেল রশিদ এবং কর্নেল ফারুক ছাড়া কারো বিরুদ্ধেই আমাদের তেমন কোন অভিযোগ নেই। Rather we expect your co-operation to fulfill our dreams. I request earnestly, please join us and strengthen our hands for the cause.
ব্রিগেডিয়ার খালেদের কথা শুনে কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। অভাবনীয় প্রত্যাশা! বুঝতে পারছিলাম না তার এ প্রস্তাবে কতটুকু আন্তরিকতা রয়েছে। পাল্টা ক্যু’দাতার তাৎপর্য কি ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার দোসররা বুঝতে পারছেন না? এটা অসম্ভব! আর সব বুঝে শুনে এ ধরণের প্রস্তাব রাখার মানে হল এটাও একটি অতি সূক্ষ্ম চাল। প্রেসিডেন্টের মত আমাদেরও এই রাষ্ট্র বিরোধী চক্রান্তে জড়িয়ে ফেলতে চাইছেন চক্রান্তকারীরা। একটু ভেবে নিয়ে আমি জবাব দিলাম,
- স্যার, এখন পর্যন্ত নিজেদের সম্পর্কে ভাববার কোন সময়ইতো পেলাম না তাছাড়া ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে সবার সাথে আলাপ-আলোচনা করা ছাড়া আমাদের পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব নয়। আলোচনার মাধ্যমেই ঠিক করা হবে আমাদের কি করা উচিত এবং আমরা কি করব। স্যার, আপনার স্বপক্ষে যারা রয়েছে তাদের অনেকেই ১৫ই আগষ্টের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সময় আমাদের স্বপক্ষেই ছিল। এ সম্পর্কে আপনিও অবগত রয়েছেন। আমি সবাইকে উদ্দেশ্য করেই বলছি, জেনারেল জিয়া আমাদের কিংবা আগষ্ট বিপ্লবের তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অথবা সেনাবাহিনীর স্বার্থ রক্ষা করে যোগ্য নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন এর কোনটাই আমরা যুক্তিসঙ্গত মনে করি না। এ ধরণের অভিযোগ এবং প্রচারণা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করি আমরা। বিনা কারণে তার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলিয়ে তার উপর অনাস্থা আনার অজুহাতে এই ধরণের একটা জাতীয় সংকট সৃষ্টি করার উদ্যোগ কখনোই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। আপনাদের শক্তি বৃদ্ধি করার প্রস্তাবর পরিপ্রেক্ষিতে শুধু এতটুকুই বলবো, ১৫ই আগষ্টের চেতনা এবং ৩রা নভেম্বরের উদ্দেশ্য এক নয়। ১৫ই আগষ্ট এবং ৩রা নভেম্বরের ঘটনা কোন দিনই বাংলাদেশের ইতিহাসে একইভাবে লেখা হবে না।

স্বৈরশাসন ও একনায়কত্বের নাগপাশ এবং বিদেশী প্রভুদের জাতাকল থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে স্বাধীনতার চেতনা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়নের পথ খুলে দেবার জন্যই সংঘটিত হয়েছিল ১৫ই আগষ্টের মহান বিপ্লব। আগষ্ট বিপ্লবের সফলতা এবং এর প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন এক উজ্জ্বল-অবিস্মরণীয় মাইলফলক হয়ে চিহ্নিত হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে। আপোষহীন সংগ্রামী বাংলাদেশীদের জন্য জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিভু হিসাবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন। পক্ষান্তরে, ৩রা নভেম্বরের ঘটনা প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠির জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চক্রান্তের কালো অধ্যায় হিসাবেই চিহ্নিত হবে ইতিহাসে। জানি, আমার এই বক্তব্য ঠিক এই মুহুর্তে আপনাদের কারো কাছেই গ্রহণীয় নয়; কিন্তু অদূর ভবিষ্যতই আমার কথার সত্য-মিথ্যা যাচাই করবে। আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তই আমরা গ্রহণ করি সেটা যথা সময়ে আপনারা জানতে পারবেন।

এভাবেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার সহযোগিদের সাথে বোঝাপড়া শেষ করে বঙ্গভবনে ফিরে এলাম। সঙ্গে এসেছিলেন তাদের দুই প্রতিনিধি কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেক। পথে নূর আমায় বলল,
- স্যার আপনি যেভাবে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে কথাগুলো বলছিলেন তাতে আমি কিন্তু বেশ কিছুটা শংকিতই হয়ে উঠেছিলাম। নূরের কথার কোন জবাব না দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম-
যুক্তিসঙ্গত কথাই বলেছে নূর। এতটা খোলাখুলিভাবে ঐ ধরণের কথা বলাটা নিঃসন্দেহে ছিল একটা বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কোন চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই কথাগুলি বেফাঁস বেরিয়ে এসেছিল মুখ দিয়ে অটোম্যাটেকেলি। নিঃস্বার্থভাবে কোন সঠিক এবং মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলে প্রয়োজনীয় সাহসিকতা হয়তো বা আল্লাহ্‌তা’য়ালাই যুগিয়ে দেন।

বঙ্গভবনে ফিরে এসে প্রেসিডেন্টকে জানালাম, চক্রান্তকারীরা জাষ্টিস সায়েমের মাধ্যমে ক্ষমতা পুনর্দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সব শুনে প্রেসিডেন্ট মোশতাক জাষ্টিস সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার এ সিদ্ধান্তের কথা জেনে নিয়ে কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেক বঙ্গভবন থেকে ফিরে যান।

 
 
 
     
     
  Design & Developed By: Hemu
All Rights Reserved 2008 @www.majordalimbangla.net