মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 
খালাম্মা, নিম্মী এবং বাপ্পির দুঃসাহসিক পলায়ন
 
   
 

কোলকাতা দূতাবাসের ডিফেক্‌শনের পর চৌধুরী পরিবারের জন্য ঢাকা কিংবা পূর্ব পাকিস্তানের কোন জায়গাই নিরাপদ ছিল না।

কোলকাতার মিশনের ডিফেকশ্‌নের খবরও আমরা জানতে পারি। এ খবর জানার পর পরিবারের সবাই বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন। বাবাও ডিফেক্ট করেছেন সবার সাথে। খবর পেলাম তার এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে পাকিস্তান সরকার। প্রতিশোধের আক্রোশে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিশ্চয়ই গ্রহণ করবে সামরিক জান্তা। সবাই একমত হলেন, আমাদের আর লালবাগে থাকা ঠিক হবে না। সরে পড়তে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি (বাপ্পি), মা ও নিম্মী বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলাম আমাদেরই এক ফুপুর বাড়ি। কোন জায়গায় বেশিদিন একনাগাড়ে থাকা ঠিক নয়। তাই আমরা পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম বাড়ি থেকে বাড়ি। এভাবে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম আনু মামার বাড়ি, শহিদ মামার শ্বশুর বাড়ি, আত্মীয় অগ্রণী ব্যাংকের ম্যানেজার পেরু মামার বাড়িতে। সে বাড়িতেই ঘটল বিভ্রাট। একদিন গোয়েন্দা বিভাগের একজন অফিসার এলেন পেরু মামার বাসায় কোন এক কাজে। সেখানে ঘটনাক্রমে তিনি মাকে হঠাৎ করে দেখে ফেলেন। মিসেস চৌধুরীকে চিনতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হল না তার। সন্দেহপ্রবন হয়ে ফিরে গেলেন ভদ্রলোক। তিনি জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের সদর দপ্তরে খবরটা পৌঁছে দেন। পরদিনই পেরু মামার বাড়ি ও লালবাগের বাসায় একই সাথে রেইড করা হল আমাদের খোঁজে। কিন্তু ভদ্রলোকের ভাবসাব বুঝে আমরা ভদ্রলোক চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই পেরু মামার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। এভাবে আমরা বেঁচে যাই সে যাত্রায়। এ ঘটনা থেকে পরিষ্কার বুঝা গেল পাকিস্তানী গোয়েন্দা বিভাগ প্রতিশোধ হিংসায় হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের। বাংলাদেশে আর থাকা সম্ভব নয়। পালিয়ে যেতে হবে সীমান্ত পেরিয়ে।

ইতিমধ্যে স্বপন, বদি ওরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। আমিও যাব তাদের সাথে। মা বাধ সাধলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে যাবে সেতো গর্বের কথা। কিন্তু তার আগে আমাদের কোলকাতায় তোমার বাবার কাছে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিতে হবে তোমাকে। আমাদের পৌঁছে দিয়ে তুমি যুদ্ধে যাবে তার আগে নয়।’ মার যুক্তিসঙ্গত অনুরোধ উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। মা ও সমর্থ বোনের পালিয়ে যাবার দায়িত্ব যার তার উপর বিশ্বাস করে দিয়ে দেয়া চলে না। আমাকেই নিতে হবে এ কঠিন দায়িত্ব । পালাবার পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। ঠিক করা হয় ঢাকা থেকে পালিয়ে যাব নানা বাড়ি নবীনগর। সেখান থেকে সুযোগ মত কস্‌বা সেক্টর দিয়ে আগরতলায় পাড়ি জমাতে হবে। নবীনগর থেকে কি করে বর্ডার ক্রস করতে হবে সেটা নবীনগর গিয়েই ঠিক করতে হবে অবস্থা বুঝে। আনু মামা, আলতু নানাকে সঙ্গে নিয়ে মা, নিম্মী ও আমি এক রাতে নরসিংদী হয়ে নবীনগর এসে পৌঁছালাম। ঢাকা থেকে নরসিংদীর গাড়িতে। সেখান থেকে লঞ্চে নবীনগর একদম বাড়ির ঘাটে। নবীনগর গ্রামে খান সেনারা তখনও হানা দেয়নি। কিন্তু তবুও দলে দলে হিন্দুরা সব বসতবাটি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল ভারতে। বর্ধিষ্ণু নবীনগর গ্রামে খাঁ বাড়ি বিশেষ পরিচিত। বড় আব্বা ও নানা দাপটশালী জমিদার হিসাবে এক কালে দশ গ্রামে বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বড় আব্বাকে বৃটিশ সরকার খেতাবেও ভূষিত করেছিল। প্রাসাদপম জমিদার বাড়ির সামনে জোড়া দীঘি। নবীনগরের মুক্ত পরিবেশে পৌঁছে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাচঁলাম। আনু মামা দু’একদিন বিশ্রাম করে ঢাকায় ফিরে গেলেন। তার পুরো পরিবার তখনও রয়েছে সেখানে। খান সেনাদের চোখে ফাঁকি দিয়ে আমরা পালিয়ে আসতে পারায় বাড়ির সবাই মহাখুশি। নবীনগরের শান্ত পরিবেশ এবং প্রকৃতির নির্মল সংস্পর্শে কয়েক দিনেই ভুলে গেলাম ঢাকার দুর্বিষহ দিনগুলোর কথা। ২৫-২৬শে মার্চ রাতের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা, বাড়ি বাড়ি লুকিয়ে প্রাণ বাঁচাবার বিড়ম্বনা, ২৭শে মার্চ সকালের তিক্ততা সবকিছুই দুঃস্বপ্নের মত অতীত হয়ে গিয়েছিল আমাদের কাছে। সনাতন দা গ্রামের বাড়ির মুরুব্বীদের একজন। পুরনো বিশ্বাসভাজন আপনজন। বংশানুক্রমে তারা খাঁ বাড়ির জমিদারী তদারক করে এসেছেন। তিনিই সব দায়িত্ব নিলেন আমাদের বর্ডার পার করে দেবার। সার্বিক দেখাশুনা ও পালাবার পরিকল্পনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও অসাধারণ বুদ্ধির অধিকারিনী সবার অতি আদরের ছোট নানী বেগম আমির আলী খান ও কবির। ছোট নানীর বড় ছেলে, হবিগঞ্জের এসডিও (SDO) জনাব আকবর আলী খান (খসরু মামা) খান সেনাদের শ্বেত সন্ত্রাসের বিরোধিতায় ইতিমধ্যেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন এবং সেই সময় আগরতলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে অবস্থান করছিলেন। ঠিক হল আগরতলাতে খসরু মামার কাছেই যাব আমরা। একই গ্রামের কলেজ পড়ুয়া ছেলে মোমেন আমাদের গাইড হয়ে সঙ্গে যাবে। সনাতন দা যাত্রার সব বন্দোবস্ত করে দেবেন। অসম্ভব উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী তরুণ যুবক মোমেন অসীম সাহসীও বটে। ইতিমধ্যেই সে কয়েকটি শরনার্থী দলকে আগরতলায় নিজ তদারকিতে পৌঁছে দিয়ে এসেছে খান সেনাদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে। কসবা সেক্টর দিয়ে আগরতলা পৌঁছানোর চোরা রাস্তাগুলো ওর নখদর্পণে। ঠিক হল নৌকাযোগে মেঘনা, তিতাস পাড়ি দিয়ে খরস্রোতা গোমতী নদী বেয়ে কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া GT Road পর্যন্ত গিয়ে তারপর পদযাত্রা। বর্ডার পার হওয়ার পর পথিমধ্যে পড়বে একটি বড়সড় বাজার। সেখান থেকে ভাড়াটে গাড়িতে আগরতলা। বড় একটা গয়না নৌকা ঠিক করলেন নানী ও সনাতন দা। মাঝি-মাল্লারা সবাই অত্যন্ত বিশ্বস্ত। দুর্যোগপূর্ণ এক ঝড়ের রাতে আল্লাহ্‌র নাম করে মোমেন, কবির ও আলতু নানাকে সঙ্গে করে নৌকায় উঠে পাড়ি জমালাম এক অজানা ঠিকানায়। দুর্যোগের রাতে খান সেনাদের চোখ অতি সহজেই ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলেই ঝড়ের রাতে নৌকা যাত্রার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। বদর বদর বলে মাঝি-মাল্লারা মেঘনার উত্তাল বুকে অন্ধকারে নৌকা ভাসিয়ে দিল। ভাল করে সাঁতার জানি না আমি ও নিম্মী দু’জনেই। ঝড়ো হাওয়ায় মেঘনা হয়ে উঠেছে বিক্ষুব্ধ। বিশাল ঢেউয়ের পাহাড় ভেঙ্গে নৌকা এগিয়ে চললো দুলতে দুলতে। ঢেউয়ের দোলা ও ঝড়ের তীব্রতার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে চুপ করে বসে আল্লাহ্‌-রাসূলকে স্মরন করতে থাকলাম সবাই। এমনি করে সারারাত একটানা নৌকা বেয়ে ফজরের ওয়াক্তে এক জায়গায় নৌকা ভেড়ালো মাঝিরা। সেখানে নেমে পড়তে হল সবাইকে।

শুরু হল পদযাত্রা। ধানক্ষেত, পাটক্ষেতের আলের উপর দিয়ে, কাদা পলির উপর দিয়ে খালি পায়ে হেটে পাহাড়ী টিলাগুলো পার হচ্ছিলাম। পরনে সবার গ্রাম্য লেবাস। দুপুরের আগেই GT Road এর কাছে পৌঁছে গেলাম আমরা। একটি পাটক্ষেতের মধ্যে সবাইকে লুকিয়ে রেখে মোমেন আর আমি এগিয়ে গেলাম রাস্তাটা রেকি করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলাম আমরা। রাস্তা ক্লিয়ার। ক্ষিপ্র গতিতে রাস্তা পার হয়ে দূরে চলে যেতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। দূরের জঙ্গলে গা ঢাকা দেবার আগে খান সেনাদের দৃষ্টিতে পড়লে রক্ষে নেই। র্নিঃঘাত মৃত্যু। পরি কি মরি সবাই দৌড়ে ছুটে চলেছি রাস্তা ক্রস করার জন্য। আর একটু গেলেই উচুঁ রাস্তা। হঠাৎ মোমেন বলে উঠলো, ‘সবাই শুয়ে পড়ুন, খান সেনাদের টহল গাড়ি আসছে।’ তার নির্দেশে সবাই ধানক্ষেতের কাঁদা পানিতে অসাড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। চারদিকে যতটুকু দৃষ্টি যায় ছোট ছোট পাহাড়, টিলা, ধান আর পাটের ক্ষেত। লোকজনের চিহ্নমাত্র নেই। ধানক্ষেতের কাদা-পানিতে মুখগুজে পড়ে থেকে সবাই প্রমাদ গুনছিলাম, ‘যদি টহলদার খান সেনারা দেখে ফেলে!’ ভয়ে নিম্মীর দু’চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। আল্লাহ্‌ই বাঁচানে ওয়ালা। খান সেনাদের গাড়িটা অল্প কয়গজ দূর দিয়ে উত্তর দিকে চলে গেল। ওরা ধানক্ষেতে পড়ে থাকা মানুষগুলি দেখতে পেল না। গাড়িটি অনেক দূরে দৃষ্টির অগোচরে চলে গেলে সবাই উঠে এক দৌড়ে রাস্তা ক্রস করে অপরদিকের পাটক্ষেতে গিয়ে বসে পড়লাম। একটু দম নেয়া দরকার। মা বেচারীর ডান পা’টা কিছুদিন আগে ভেঙ্গে গিয়েছিল ইউনিভার্সিটির সিড়ি থেকে পিছলিয়ে গিয়ে। ভাঙ্গা পা’টা দুঁনিয়ে ফুলে উঠেছে। অসম্ভব সহ্য শক্তি মার। মুখ ফুটে কখনও নিজের অসুবিধার কথা ব্যক্ত করে না। তাই শুধু বলল, একটু দম নেয়া যাক। আমি ও নিম্মী মার পায়ের অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম হাটতে ভীষণ অসুবিধে হচ্ছে তাঁর। বুঝতে পারলেও কিছুই করার নেই।
বাকিটা পথ হেটেই যেতে হবে তাঁকে। মাঝামাঝি পথ অতিক্রম করেছি আমরা। এখন থেকে বাকি পথের সবটুকুই পাহাড়ী উচু-নিচু পিচ্ছিল পথ। সবাই কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম কিন্তু মুখে কিছুই বললাম না। মাকে উৎসাহ দেবার জন্য হেসে বললাম, ‘মা তুমি দেখছি হাটাতে আমাদেরকেও হার মানিয়ে দিলে। কষ্ট হচ্ছেনা তো?’ কোন জবাব না দিয়ে মা উঠে দাড়াল। আবার শুরু হল হাটা। হাটতে হাটতে সন্ধ্যার সময় আমরা পৌঁছলাম সেই বাজারে। বর্ডার এলাকার বাজার। কিন্তু শরণার্থীদের ভীড়ে পুরো বাজারটাই গমগম করছে। চালের বস্তা ভর্তি অসংখ্য ট্রাক দাড়িয়ে আছে। মোমেন বলল, ‘আমরা পৌঁছে গেছি।’ ঐ চাল বাংলাদেশ থেকে স্মাগলড হয়ে চলে যাচ্ছে ইন্ডিয়ায়। কিছুদূর এগুতেই বাজারের অন্যপ্রান্তে একইভাবে দাড়িয়ে আছে পাট ভর্তি ট্রাকের সারি। ওগুলোও পাচার হচ্ছে বাংলাদেশ থেকেই।

দীর্ঘপথ চলায় সবাই তখন পরিশ্রান্ত। একটা চায়ের দোকানে বসে পানি, কিছু চা-নাস্তা খেলাম সবাই। খাওয়া শেষে একটি পুরনো জিপ গাড়ি ভাড়া করে আগরতলার পথে রওনা হলাম। ছোট্ট জিপটাতে প্রায় ১২জন যাত্রী ঠাসাঠাসি করে ঢোকালো ড্রাইভার। কিছুই বলার নেই। এটাই রীতি। বাজার থেকে আগরতলার দূরত্ব প্রায় পঁয়ত্রিশ মাইল। পুরনো সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার আমলের জিপ। ১২-১৪ জন যাত্রীর ভারে আর্তনাদ করতে করতে কোনমতে এগিয়ে চললো আগরতলার পথে। কিছুদূর যাবার পর গাড়ি থামিয়ে বনেট খুলে পানি ঢেলে বুড়ো ইঞ্জিনকে ঠান্ডা করতে হচ্ছিল বারবার। এভাবেই অতি কষ্টে রাত প্রায় ১২টায় আমরা এসে পৌঁছালাম আগরতলা শহরে।

শহর থেকে ৫-৬ মাইল দূরে এক পোড়া রাজবাড়িতে খসরু মামা ও আরো কয়েকজন পদস্থ বাঙ্গালী অফিসার সপরিবারে অবস্থান করছিলেন। মোমেন জায়গাটা আগেই দেখে গেছে। জিপ থেকে নেমে রিক্সা করে চলে গেলাম সেই আস্তানায়। রাজবাড়িতে পৌঁছে খুজে বের করতে বেগ পেতে হলনা খসরু মামাকে। খসরু মামা আমাদের সবাইকে দেখে অবাক,
-হেনা বুজি আপনারা?
-হ্যাঁ পালিয়ে এলাম। মোমেনই নিয়ে এসেছে আমাদের। ঢাকায় থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।