মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 
দিল্লীর অভিজ্ঞতা
 
   
 

 

দিল্লীতে আমাদের মিশ্র অভিজ্ঞতা হয়। উষ্ণ অভ্যর্থনায় আমরা খুশী হয়েছিলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ এবং ভবিষ্যত বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় নীল নক্‌শা আমাদের হতাশ করেছিল।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের প্ল্যান অনুযায়ী ২০শে এপ্রিল Ministry of External Affairs এ গিয়ে নিজেদের সারেন্ডার করলাম রাষ্ট্রপতি ভবনের সাউথ ব্লকে। সেখানে আমাদেরকে জেনারেল ওবান সিং (তদানিন্তন রিসার্চ এন্ড অ্যানালাইসিস উইং (RAW) প্রধান) এর হাতে আমাদের হস্তান্তর করা হলো। তখন থেকেই আমরা রইলাম তার নিয়ন্ত্রণে। ব্রিগেডিয়ার নারায়ণ নামের এক ভদ্রলোক হলেন আমাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। ৪ দিন ৪ রাত্রি আমাদের কঠিন সওয়াল সেশন চললো। সেশনগুলো পরিচালনা করেছিলেন বিভিন্ন গোয়েন্দা বিভাগের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞরা। আমরা যতটুকু সম্ভব সোজাসুজি এবং সত্য জবাবই দেবার চেষ্টা করছিলাম।

একদিন বিকেলে জনাব একে রায় দু’জন ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে আমাদের সাথে দেখা করতে এলেন। ভদ্রলোক দু’জন ছিলেন জনাব শাহাবুদ্দিন ও জনাব আমজাদ হোসেন। জনাব শাহাবুদ্দিন ও জনাব আমজাদ হোসেন দ্বিতীয় ও তৃতীয় সচিব হিসেবে পাকিস্তান দিল্লী মিশনে কর্মরত ছিলেন। প্রবাসী সরকার ১৭ই এপ্রিল গঠিত হওয়ার খবর জেনে তারা দু’জনে দুতাবাস থেকে Defect করে ভারতীয় সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্র্থনা করেন। ভারত সরকার তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করে তাদের নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তাদেরকেও আমাদের মত গোপন আরেকটি সেফ হাউজে রাখা হয়েছে। আমাদের মত দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ হয়ে এ দু’জন তরুণ অফিসারও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। খুব খুশি হলাম ওদের পেয়ে। তারাও খুশি হলেন আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করে। ওরা বাংলাদেশের সংগ্রাম সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছুই বলেছিলেন। আমাদের মতো অভিজ্ঞ অফিসার যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রয়োজন, তারা সে কথাও উল্লেখ করলেন।

ইতিমধ্যে আমরা বিগ্রেডিয়ার নারায়ণকে জিজ্ঞেস করেছিলাম মুজিবনগর সরকারের সাথে আমাদের বিষয়ে ভারত সরকার কোন যোগাযোগ করছে কিনা? জবাবে বিগ্রেডিয়ার জানিয়েছিলেন যোগাযোগ করা হয়েছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কয়েকজন নেতা আসছেন দিল্লীতে। তাদের কাছেই আমাদের হ্যান্ডওভার করে দেওয়া হবে। এটা ছিল আমাদের জন্য একটি বিশেষ সুখবর। অবশেষে, একদিন প্রতিনিধি দল এসে পৌছাল। জনাব তাজুদ্দিন আহমদ (প্রধানমন্ত্রী), জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ (পররাষ্ট্র মন্ত্রী) এবং কর্নেল ওসমানী (মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ) এরাই প্রতিনিধি দলের মূল ব্যক্তি। বৈঠকের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন হঠাৎ করে বললেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে আমাদের আরো সপ্তাহ দু’য়েক দিল্লীতেই থাকতে হবে। এ সময়ে ভারতীয় বিভিন্ন এজেন্সির বিশারদরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সর্ম্পকে ব্রিফিং দেবেন এবং স্পেশালাইজড অফিসার হিসেবে আমাদের যুদ্ধে যোগদানের পর যে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হবে সে বিষয়েও বিস্তারিত জানাবেন।

তার সিদ্ধান্ত শুনে কিছুটা অবাক হলাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে না জেনে ভারতীয় সরকারের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ব্রিফিং নিতে হবে কেন? তাহলে আমাদের সংগ্রামের প্রতি ভারত সরকারের সহানুভূতি নিঃস্বার্থ নয়? বুঝতে পারলাম ভারত সরকারের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর। মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপারে ভারত সরকারের মনোভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। কেমন যেন ঘোলাটে ঠেকলো ব্যাপারটা। বেশ কিছু প্রশ্ন দেখা দিল মনে।

বাংলাদেশের সংগ্রাম কাদের সংগ্রাম? কাদের নিয়ন্ত্রনে সংগঠিত হচ্ছে এ যুদ্ধ? ভারত নেপথ্যে থেকে কি স্বার্থে কলকাঠি নাড়ছে? পৃথিবীর সব দেশের স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম জাতীয় সংগ্রাম হিসেবে সংগঠিত হয়েছে, জাতীয় সরকারের অধিনে। আমাদের বেলায় এর ব্যাতিক্রম কেন? কেন তড়িঘড়ি করে প্রবাসে দলীয় আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত করা হল ভারত সরকারের প্রচ্ছন্ন অনুমোদনে? জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নিয়োজিত আপামর জনগণের উপর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব চাপিয়ে দেয়ার উদ্দ্যেশ্য কি? আইয়ূব বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে শুরু করে উনসত্তরের গণআন্দোলন সবকিছু সংগঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল সবগুলো রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের একলা চল নীতি কি কারণে সমর্থন করছে ভারত সরকার?
পরদিন আমাদের স্থানান্তরিত করা হল দিল্লীর পালাম আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের কাছে গ্যারিসন এলাকার একটি সামরিক প্রশিক্ষন কেন্দ্রে। সেখানে পরিচয় হল মেজর সুরজ সিং এর সাথে। পাকানো স্বাস্থের অধিকারী মেজর সুরজ সিং একজন বিচক্ষণ কমান্ডো এবং Insurgency and counter insurgency expert; ব্রিগেডিয়ার নারায়ণও তাই। এরা দু’জনেই আমাদের মূল শিক্ষক। আমাদের জন্য দু’সপ্তাহের একটি crash course এর বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পাঠ্যক্রমের মধ্যে Insurgency and counter insurgency, guerilla warfare, urban warfare, jungle warfare, shall arms, explosive, unarmed combat সবকিছুই রয়েছে। Specialized officer হিসেবে আমরা তিনজনই এ সমস্ত বিষয়ে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত। তবুও যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দেবার আগে আমাদের জ্ঞানকে ঝালাই করে নেবার সুযোগ পেয়ে ভালোই হল। শুরু হল আমাদের প্রশিক্ষন। এ সমস্ত বিষয়গুলোর পাশাপাশি চললো স্বাধীনতা সংগ্রাম সংক্রান্ত ব্রিফিং। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মির শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট, পুলিশ, ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ প্রভৃতি সংগঠনের বাঙ্গালী সদস্যরা। তাদের কেন্দ্র করে জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণে সৃষ্টি হয়েছে মুক্তি সংগ্রাম। এ সংগ্রামে যোগ দিয়েছে দলমত নির্বিশেষে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক ও অন্যান্য পেশাধারী জনগণের বৃহদাংশ। ভারত সরকার বাংলাদেশের ঘটনাবলী অতি সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষন করছে। বাংলাদেশ থেকে বর্ডার ক্রস করে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে লক্ষ লক্ষ শরনার্থী। এভাবেই ভারত সরকার সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে, অনেকটা মানবিক কারণেই। স্বতঃর্স্ফুতভাবে গড়ে উঠা স্বাধীনতার সংগ্রামকে ফলপ্রসু করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক নেতৃত্বের। আওয়ামী লীগকেই দিতে হবে সেই নেতৃত্ব। এর জন্যই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে অস্থায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। ভারত আওয়ামী লীগ ও অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে বিশ্বাস করে। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে সংগঠিত করে তুলতে হবে এ সংগ্রাম। আওয়ামী লীগ ও সদ্য গঠিত প্রবাসী সরকারের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রনের বাইরে অন্য কোন রাজনৈতিক দল ভিন্ন কোন রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী গ্রুপ কিংবা ব্যক্তি কাউকেই কোন সাহায্য করবে না ভারত সরকার। আওয়ামী লীগ সরকারের একক কর্তৃত্ব অস্বীকার করে বিরোধিতা করতে পারে মূলতঃ দুইটি প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি।

প্রথমত: পাকিস্তান সেনা বাহিনীর প্রাক্তন সব সদস্যরাই দীর্ঘ দিন যাবত রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদারিত্ব করেছে। তাদের কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছে প্রতিরোধ সংগ্রাম। তাই এ সংগ্রামের কর্তৃত্ব দাবি করে তারা ক্ষমতালিপ্সু হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারেন।

দ্বিতীয়ত: হুমকি আসতে পারে চরমপন্থী নকশালীদের কাছ থেকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অনুপ্রবেশ ঘটেছে চরমপন্সীদের। তাছাড়া বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী পশ্চিম বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা মনিপুর, মিজোরাম প্রভৃতি প্রদেশে নকশালী তৎপরতা ক্রমবর্ধমান। ভারতের পূর্বাঞ্চলের নকশালীরা বাংলাদেশের চরমপন্থীদের সাথে এক হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের সুযোগে মিলিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠতে পারে। এই মিলিত শক্তি আবার একত্রিতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে নেবার চেষ্টাও করতে পারে ঐ সমস্ত অঞ্চলের চলমান বিচ্ছিন্নবাদী সংগ্রামে। এসমস্ত ক্ষমতালিপ্সু শক্তিসমূহকে সমূলে উৎপাটন করে যুদ্ধাবস্থায় এবং যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ এখন থেকেই গ্রহণ করা উচিত বলে ভারত সরকার মনে করে। একইভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যাতে কোনক্রমেই ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হয়ে না দাড়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চক্রান্তের ফলে তার জন্যও প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। এ ব্যাপারে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রীও একমত হয়েছেন। যৌথ উদ্যোগে একটি পরিকল্পনাও প্রনীত হয়েছে। ঠিক হয়েছে, আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্য থেকে বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে একটি বিশেষ রাজনৈতিক সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা হবে। এ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা হবে এক লক্ষ। বিশেষ ট্রেনিং ক্যাম্পে ওদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে ভারতীয় সেনা বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। এ বাহিনীর রিক্রুটমেন্ট, ডিপ্লয়মেন্ট ট্রেনিং সব কিছুই থাকবে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডের আওতার বাইরে। এ বাহিনী সরাসরিভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দ্বারা। এদের সশস্ত্র করা এবং পরিচালনা করার দায়িত্ব নেবে ভারত সরকার। ভারত সরকারের তরফ থেকে এ বাহিনী গঠনের মূল দায়িত্বে থাকবেন জেনারেল ওবান সিং। এদের মূল কাজ হবে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা। প্রশিক্ষণের পর এদের দলে দলে পাঠানো হবে বাংলাদেশের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ অধ্যায়ে। ভেতরে গিয়ে নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত করে তারা প্রস্তুত হয়ে থাকবে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি যে কোন চ্যালেঞ্জ এর মোকবিলা করার জন্য। এ বাহিনীর নাম রাখা হবে বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স)। যুদ্ধকালে এবং স্বাধীনতার পরে পর্যায়ক্রমে ঐ বাহিনীর নাম রাখা হয় মুজিব বাহিনী এবং কুখ্যাত রক্ষীবাহিনী। বাংলাদেশ সরকার আমাদের তিনজনকে মনোনীত করেছে ভারতীয় সেনা বাহিনীর সহযোগিতায় এই বিএলএফ গঠন করার জন্য। আমাদের totally non-political মনে করে এবং মুজিবর রহমানের প্রতি আমাদের অগাধ শ্রদ্ধা দেখেই বোধ হয় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আমাদের পেশাগত যোগ্যতা, সাহস, অন্ধ দেশপ্রেম, ব্যাকগ্রাউন্ড এবং সিনসিয়ারিটি সম্পর্কে নিশ্চয়ই কনভিন্স হয়েছিলেন দুই সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল। সুদূরপ্রসারী এ নীল নকশা এবং ভারত সরকারের মনোভাব জানতে পেরে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে উঠল। গত কয়েকদিন যাবত মনে যে সমস্ত প্রশ্নগুলো দেখা দিয়েছিল সেগুলোর অনেকগুলোরই জবাব পেয়ে গেলাম। জানবাজী রেখে যারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, অকাতরে প্রাণ দিতে কুন্ঠিত হচ্ছেন না যারা, তাদের প্রতি কী অবিশ্বাস! ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য নিবেদিত প্রাণ মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার কী ভয়ানক ষড়যন্ত্র! শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তের সাথে কী চরম বিশ্বাসঘাতকতা! চানক্যবুদ্ধির এ নীল নকশা ফাটল সৃষ্টি করবে জাতীয় ঐক্যে। জাতি হয়ে পড়বে বিভক্ত। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত হয়ে উঠবে দুর্বল। নস্যাৎ হয়ে যাবে জাতীয় সংগ্রামী চেতনা। অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত দুর্বল বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি করদ রাজ্যে। নাম সর্বস্য বাংলাদেশের খোলসে অর্থহীন হয়ে পড়বে স্বাধীনতা। আট কোটি বাংলাদেশীর মুক্তির আকাঙ্খা পথ হারাবে বিশ্বাসঘাতকতার চোরাবালিতে। একই সাথে র্নিমূল করা হবে ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার স্বাধীনতার সংগ্রামগুলোকেও।

মন বিদ্রোহ করে উঠল। এ চক্রান্তের অংশীদার হতে পারবো না। প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে এ নীল নকশার বিরুদ্ধে। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে বুঝিয়ে বলতে হবে সহযোদ্ধাদের। ঐক্যমত্য সৃষ্টি করতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে; অতি সংগোপনে। অন্যের দেয়া নামেমাত্র স্বাধীনতা নয়, প্রকৃত স্বাধীনতাই অর্জন করতে হবে। নিজেদের শক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। শিক্ষা নিতে হবে গণচীন, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাস থেকে।

১৯৭১ সালের ২৫-২৬শে মার্চের কালোরাত্রি, মুক্তিযুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি এবং যুদ্ধ সর্ম্পকে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি সর্ম্পকে মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার বই ‘সামরিক শাসন ও গণতন্ত্রের সংকট’ এ লিখেছেন, “২৫শে মার্চের রাতে সামরিক জান্তার পাশবিক ক্র্যাকডাউনের পর যেহেতু ঐ ধরনের কোন সামরিক অভিযানের মোকাবেলা করার কোনো প্রস্তুতি আওয়ামী লীগের ছিল না সেই পরিপ্রেক্ষিতে নেতাদের সবাই ভারতে পালিয়ে গিয়ে কোলকাতায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ‘অখন্ড ভারতের’ স্বপ্নদ্রষ্টা পন্ডিত জওহর লাল নেহেরুর যোগ্য উত্তরাধিকারী দীর্ঘদিন যাবত এ ধরনের একটি সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। শ্রীমতি গান্ধী এই সুবর্ণ সুযোগের সময়মত যথাযথ সদব্যবহারই করলেন। ভারত যে শুধুমাত্র তাদের দীর্ঘদিনের প্রধান ও এক নম্বর শত্রু পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করে দেশটিকে দুর্বল করতে সক্ষম হয় তাই নয়; এই মুক্তিযুদ্ধের আবরণে সাফল্যের সাথে পশ্চিমবঙ্গ ও তার আশেপাশের প্রগতিশীল বিচ্ছিন্নতাবাদী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলোকেও নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়।”

২৫-২৬শে মার্চ ১৯৭১ এর বিভিষিকাময় কালোরাত্রির প্রত্যক্ষ সাক্ষী:
খালাম্মা, নিম্মী এবং বাপ্পী ২৫-২৬শে মার্চের আর্মি অপারেশন এবং এর ভয়াবহ পরিণামের জীবন- সাক্ষী। তাদের বর্ণনা লোমহর্ষক এবং এক করুণ উপাখ্যান।

ফেব্রুয়ারীর শেষে মা (খালাম্মা) কোলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। উদ্দ্যেশ্য দেশের অবস্থা দেখে শুনে প্রয়োজন হলে আমাকে ও নিম্মীকে সঙ্গে নিয়ে কোলকাতায় ফিরে যাবেন। ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১০টা অব্দি তিনি শেখ সাহেবের বাসাতেই ছিলেন। ৩২নং ধানমন্ডি থেকে লালবাগের বাসায় ফেরেন রাত প্রায় সাড়ে দশটায়। বাসায় ফেরার পর সবাই তাকে ধরে বসলাম নেতা কি বললেন? মা শুকনো বিচলিত কন্ঠে জবাব দিলেন,
-নেতাকে অনেক বোঝানোর পরও তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে রাজি হলেন না। পার্টির নেতা কর্মীরা, ছাত্রনেতারা, অন্যান্য অনেকেই আসন্ন সামরিক অভিযান সম্পর্কে শেখ মুজিবকে সতর্ক করে দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, পাক বাহিনী যদি জনগণের উপর ঝাপিঁয়েই পড়ে তখন জনগণের পাশে থেকে প্রতিরোধ সংগ্রামে তিনি তাদের নেতৃত্ব দেবেন সেটাই তাদের প্রত্যাশা। কিন্তু শেখ মুজিবর রহমানের এক কথা, তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। অস্ত্রের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না। পাক বাহিনী নিরীহ জনগণের উপর শ্বেত সন্ত্রাসের ষ্টিম রোলার চালিয়ে দেবে এ ধারণা সম্পর্কেও তার দ্বি-মত ছিল। তিনি উপস্থিত সবাইকে বলেছিলেন, প্রয়োজনবোধে সামরিক  জান্তা তাকে বন্দী করবে কারণ তাদের বিরোধ তার সাথে। কিন্তু অনেকেই যুক্তি দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করেছিল যে বর্তমানের দ্বন্দ্ব শুধু সামরিক জান্তা ও শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; আজকের দ্বন্দ্ব সামরিক জান্তা এবং বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে। এ সত্যকে অস্বীকার করা হবে মারাত্মক ভুল। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ আজ স্বাধীনতার জন্য উম্মুখ। যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতেও তারা প্রস্তুত। এক্ষেত্রে নেতৃত্বের দায়িত্ব হবে তাদেরকে সংগঠিত করে যে কোন অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত থাকা। সামরিক অভিযানের মোকাবেলায় প্রয়োজনবোধে অস্ত্রও হাতে তুলে নিতে হতে পারে। এর জন্য মানসিকভাবে নেতৃত্ব ও জনগণকে তৈরি থেকে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তুতিও নেয়া উচিত। এতেই কমবে সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি, জনগণ ছিনিয়ে নিতে পারবে তাদের ইপ্সিত স্বাধীনতা। কিন্তু শেখ মুজিব কোন যুক্তিই গ্রহণ করলেন না। তার শেষ কথা, ‘২৭শে মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালিত হবে।’ এ কর্মসূচী ঘোষণা করে তিনি সবাইকে বিদায় করলেন। ঘোষণার সাথে এটাও তিনি বলেছিলেন,‘পাক বাহিনীর আক্রমনের ভয় যারা করেন তারা গোপন আস্তানায় গা ঢাকা দিতে পারেন।’ সেদিন রাতে যারা ৩২নং ধানমন্ডিতে সমবেত হয়েছিলেন তারা তার নেতিবাচক মনোভাবে হতাশ হয়েই ফিরে গিয়েছিলেন তার ঘোষণা শোনার পর। মাও ফিরে এসেছিলেন চিন্তিত মন নিয়ে। যেখানে সবাই ধারণা করছে পাক বাহিনী সামরিক অভিযান চালাবে সেখানে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের কি কোন কিছুই করার নেই? জনগণকে সে ধরণের শ্বেত সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা করার কোন দায়িত্বই কি নেই জনাব শেখ মুজিব ও তার দলের? তাহলে সেই চরম পরিাস্থতির হাত থেকে সাধারণ নিরস্ত্র জনগণকে বাচাঁবে কোন নেতৃত্ব? শেখ মুজিব ও তার দল আওয়ামী লীগকেই তো নেতৃত্বের স্থানে মেনে নিয়েছে দেশবাসী। তাদের ডাকেই তো সাড়া দিয়ে সংগ্রামকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে জনগণ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। সংগ্রামের চরম পর্যায়ে কেন তবে নেতা শেখ মুজিব পিছিয়ে যাচ্ছেন জনগণকে আগে ঠেলে দিয়ে? এ সমস্ত প্রশ্নগুলোর জবাব খুঁজে না পেয়ে মা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল; আতংকিত হয়ে উঠেছিল তার স্পর্শকাতর মন। সচেতন বিবেক তার কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না নেতার এ ধরণের নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। সব বৃত্তান্ত শুনে আমরা সবাই হতবাক! এটাই যদি শেষ সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে তবে কি আর করার আছে? শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় সময় অতিবাহিত করা ছাড়া কিছুই করার নেই। একমাত্র সময়ই বলতে পারবে শেখ মুজিবের চিন্তা-ভাবনা ও তার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা কতটুকু!

মার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ রাতটা সবাই জেগেই কাটাব ঠিক হল। বাবুন ও আমি খাবার পর কিছুক্ষণের জন্য বাইরে বের হলাম অবস্থা বুঝে আসার জন্য। রাত প্রায় ১১.৩০ মিনিটের দিকে ফিরে এসে জানালাম নিউমার্কেট, ইউনিভার্সিটি এলাকায় আর্মি টহল দিচ্ছে। রেডিও ষ্টেশনেও কড়া আর্মি নিরাপত্তা বহাল করা হয়েছে। সমস্ত শহর ছেয়ে গেছে আর্মিতে। রাত বেশ গভীর। হঠাৎ ঘড়ঘড় শব্দ করে কিছু একটা এগিয়ে আসছে বলে মনে হল। শব্দটা ভালো করে শুনে আমি বললাম, শহরে ট্যাংক নামানো হয়েছে। ঐ বিকট ঘড়ঘড় শব্দটা ট্যাংক চলার শব্দ। শহরে এত রাতে ট্যাংক কেন! এক অজানা আশংকায় সবার চোখ-মুখ শুকিয়ে গেল। দেয়াল ঘড়িটাতে সময় এগিয়ে চলছে টিক্‌টিক্‌। রাত প্রায় বারোটা। আচমকা রাতের নিরবতা ভেঙ্গে গর্জে উঠলো কামান, মর্টার, ট্যাংক, মেশিনগান, রিকয়েলেস্‌ রাইফেল। কেপে উঠল গোটা ঢাকা শহর। জানালার কয়েকটি কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল ভূ-কম্পনে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হুমড়ি খেয়ে পরলাম ঘরের মেঝেতে। আমি তড়িৎ গতিতে ঘরের আলো নিভিয়ে দিলাম। সবরকম অস্ত্র নিয়ে পাক বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘুমন্ত বাঙ্গালী জাতির উপর। গোলাগুলির আওয়াজ আসছে সবদিক থেকেই। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালাম, সমস্ত আকাশ ফ্লেয়ার ও ট্রেসারের আলোতে উদ্ভাসিত। আগুনের ফুলকির মত ছুটে চলেছে অগুনিত ট্রেসার বুলেট। আজিমপুর, নিউমার্কেট, পিলখানা, ইউনিভার্সিটি এলাকায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আকাশে পেঁচিয়ে উঠে যাচ্ছে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী, অল্পক্ষণ পরে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে শোনা গেল মানুষের মরনকান্না, আহতের আর্তনাদ। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মৃত্যু যন্ত্রনার হাহাকার পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। শ্বেত সন্ত্রাসের পাশবিক তান্ডবলীলায়  কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে পরে থাকলাম সবাই। এভাবেই কেটে গেল রাত। সকাল হল। পোড়া বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। রেডিও খুলতেই শোনা গেল বিশেষ জরুরী ঘোষণা, গতকাল মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি করা হয়েছে। জনগণকে বাইরে বেরুতে মানা করা হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের সাথে না জড়ানোর জন্য হুশিঁয়ার করে দেয়া হচ্ছে সবাইকে। কারফিউ জারি করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্যে, কিছুই করার নেই। শেখ মুজিব ও তার দলের চিন্তা-ভাবনা ভুল প্রমাণিত হল। আমরা সবাই নেতার কথাই ভাবছিলাম। ক্ষণিকের জন্য মনে ভেসে উঠেছিল তার চেহারাটা। নেতা কি অবস্থায় আছেন? আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবৃন্দই বা কোথায়? কারফিউ চলছে। বেরোবার কোন উপায় নেই। বাসায় দরজা-জানালা বন্ধ করে পুরো ২৬শে মার্চ সবাই অন্তরীন হয়ে থাকলাম। সন্ধ্যার পর আবার গোলাগুলি, আর্তনাদ, মিলিটারি বহনকারী যানবাহন চলাচলের শব্দ, ভারী বুটের আওয়াজ রাস্তায়। নিশ্চুপ হয়ে আলো নিভিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দোয়া-কালাম পড়তে থাকলেন সবাই। অত্যন্ত অসহায় অবস্থা। যে কোন মুহুর্তে দরজা ভেঙ্গে বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে জল্লাদ বাহিনী। শুরু হতে পারে লুটতরাজ, মারপিট, ধর্ষণ। বাড়ির সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে ছিলাম আমি, বাবুন, মুন্নি, নুন্নি এবং মাও। মেয়েদের সবাইকে ছাদে পানির ট্যাংকে লুকিয়ে রাখা হল। চরম যে কোন অঘটন ঘটার প্রতীক্ষায় অসহায় চেতনাহীন অবস্থায় বসে রইলেন মুরুব্বীরা। সময় কাটছিল না কিছুতেই। ভোর হল একসময়। সূর্যের আলোয় প্রাণ ফিরে পেয়ে জীবন্ত হয়ে উঠলাম সবাই। রেডিও খুলতেই ঘোষণা শোনা গেল, সরকার কিছু সময়ের জন্য কারফিউ তুলে নিয়েছে সাধারণ জনগণের সুবিধার্থে। ঘর থেকে সামনের রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। ৫-৬ জন ইপিআর এবং বাঙ্গালী সৈনিকদের একটি ছোট দল ছুটে আসছে দেখতে পেলাম। তাদের মধ্যে দু’জন গুরুতরভাবে আহত। রক্তে ভেসে গেছে ওদের পরিধেয় কাপড়-চোপড়। কাছাকাছি পৌঁছে তাদের একজন আকুতি জানালো,
-ভাই একটু পানি দেন।
বললাম,
-নিশ্চয়ই। আসুন আমাদের বাসায়।
-না ভাই, আমাদের সময় নেই। অতি কষ্টে পালিয়ে বেচেছি। নদীর ওপারে না পৌঁছার আগে আমরা নিরাপদ নই। খান সেনারা আমাদের মত সবাইকে হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। দেখতে পেলে রক্ষা নেই। কুকুরের মত গুলি করে মারবে।
আমি দৌড়ে গিয়ে বাবুনের সহায়তায় বালতি করে পানি এনে তাদের খাওয়ালাম। পানি খাবার পর ওরা কিছুটা প্রকৃতস্থ হল।
-আপনাদের এ অবস্থা কেন? জিজ্ঞেস করলাম।
-ভাই হানাদার বাহিনী সব শেষ করে ফেলেছে। তারা মাঝরাতে অতর্কিতে হামলা করে পিলখানা, পুলিশ লাইন ও ক্যান্টনমেন্টের বাঙ্গালী ইউনিটগুলির উপর। ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছে হাজার হাজার সৈনিক। যারা পেরেছে তারা পালিয়ে বেচেঁছে আমাদের মত। বস্তিগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ইউনিভার্সিটির হলগুলোকে গোলার ঘায়ে ধুল্যিসাৎ করে দেয়া হয়েছে। মারা গেছে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী। সমস্ত শহরে আর্মি টহল দিচ্ছে। কাউকে দেখে এতটুকু সন্দেহ হলেই গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। আপনাদের মত তরুণরাই ওদের টার্গেট। ভাই আপনারাও পালান। চলে যান শহর ছেড়ে গ্রামে। হানাদার বাহিনীর কবল থেকে জাতিকে বাঁচাতে হলে গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ সংগ্রাম। এ সংগ্রামে আপনাদের মত তরুণ যুবকদের প্রয়োজন হবে সবচেয়ে বেশি। আচ্ছা চলি ভাই। বেচে থাকলে দেখা হবে ইনশাল্লাহ্‌।

বিদায় জানিয়ে একইভাবে দৌড়ে চলে গেল ওরা। জোয়ান ভাইদের কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম সবাই। একি ব্যাপার! কি করে এতটা বর্বর আর হিংস্র হয়ে উঠতে পারল পাকিস্তানের শাসকরা! তাদের হঠকারী পদক্ষেপ পাকিস্তানের অখন্ডতার মূলেই কুঠারাঘাত হেনেছে। এরপর পূর্ব পাকিস্তান কোনক্রমেই আর পাকিস্তানের অংশ হিসাবে থাকতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করেই এই ন্যাক্কারজনক শ্বেত সন্ত্রাসের জবাব দিতে হবে। কারফিউ উঠিয়ে নেয়ার সুযোগে বাইরে বেরিয়ে অবস্থাটা সচক্ষে একটু দেখে আসার ইচ্ছে হল। বাসায় ফিরে প্রস্তাবটা দিতেই মা, বাবুন এবং নিম্মী সঙ্গে যেতে চাইলো। কোন যুক্তিই তারা শুনল না। একা আমাকে কিছুতেই ছাড়বেনা ওরা। অগত্যা চারজনই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তায় অসম্ভব ভীড়। লোকজন, যানবাহন সবই ছুটে চলেছে উর্ধ্বশ্বাসে। সবাই চলেছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ বেরিয়েছে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। বাসার কাছের বস্তি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সমস্ত বস্তি লোকশূন্য। নিউমার্কেটের পাশে, কাটাবন, নীলক্ষেত বস্তিরও একই অবস্থা। সমস্ত পিলখানা আর্মি ঘিরে রেখেছে। প্রতিটি রাস্তায় মেশিনগান ফিট করা খান সেনা বহনকারী ট্রাকগুলো টহল দিচ্ছে। রাস্তার স্ট্র্যাটেজিক পজিশনে ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি এলাকা একদম ফাঁকা। থমথম করছে। ইকবাল হল (ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রস্থল), জগন্নাথ হল, রোকেয়া হল মর্টার ও ট্যাংক ফায়ারে ইট ও কংক্রিটের ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। হলগুলোর মাঠে বুলড্রেজার দিয়ে গণকবর খুড়ে পুতে দেয়া হয়েছে মৃত ব্যক্তিদের লাশগুলো। রোকেয়া হলের কাছে এ ধরণের একটি গণকবরে তাড়াহুড়া করে পুতে রাখা একটি লাশের দু’টো পা বেরিয়ে রয়েছে দেখতে পেলাম। দেখে আতঁকে উঠলাম সবাই। মিলিটারি গাড়িগুলো থেকে খান সেনারা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিল আমাদের। হঠাৎ মার খেয়াল হল এভাবে ঘোরাফেরা করাটা মোটেও নিরাপদ নয়। বাসাবো, রামপুরা টিভি ষ্টেশন, কমলাপুর রেল ষ্টেশন, রেডিও ষ্টেশন ঘিরে রেখেছে শত শত আর্মি। কালো পোশাক পরিহিত মিলিশিয়া বাহিনীকেও নামানো হয়েছে। সব জায়গায় বস্তিগুলো পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে দু’রাতের মধ্যেই। মালিবাগে তোদের বাসায় সবার খবর নিতে গেলাম। আমাদের দেখে চাচা অবাক হয়ে গেলেন। ভীষণ রেগে গিয়ে মাকে বললেন,
-কোন সাহসে আপনারা বেরিয়েছেন? এক্ষুণি ফিরে যান। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে যান নদী পার হয়ে। আমরাও সরে পড়ছি। ঢাকা শহর মোটেও নিরাপদ নয়।